বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) এর বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মুখে আতঙ্কে মারমা সম্প্রদায়ের অন্তত ৫১টি পরিবারের ১৪৬ জন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রাম ছেড়েছেন, আশেপাশের আরো বেশ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে আছেন। আর এই অভিযানে ১ জন কেএনএফ সদস্য নিহত ও অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করেছে যৌথ বাহিনী। গত শনিবার সন্ধ্যায় রুমার পাইন্দু ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মুলপি পাড়ার মারমা সম্প্রায়ের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উহ্লামং মারমা। উহ্লামং জানান, পাহাড়ে কেএনএফ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় গত শনিবার সন্ধ্যার পর থেকে রোববার পর্যন্ত মোট ৫১ মারমা পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রাম ছেড়েছে। পরিবারগুলো যে যেখানে পেরেছে, সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। রোববার দুপুরে রুমা উপজেলার আরথাহ পাড়া ও বাচলং পাড়ার মাঝামাঝি একটি স্থান থেকে এক কেএনএফ সদস্যের লাশ উদ্ধার করে সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ, তবে নিহতের নাম পরিচয় জানা যায়নি। এসময় ঘটনাস্থল থেকে ১টি অস্ত্র ও ৩৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা করে পুলিশ। যৌথবাহিনী বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায় সে। রুমা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। চেয়ারম্যান উহ্লামং আরো বলেন, ওই এলাকার অধিকাংশ গ্রামের লোকজন রুমা সদরের মারমা ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে। তাদের খাবার, কম্বল ও থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা রুমা সদরে অবস্থান করবেন। স্থানীয়রা জানান, রুমা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে মুলপি পাড়া গ্রাম। ওই গ্রামে বম সম্প্রদায়ের ৮০টি ও মারমা সম্প্রদায়ের ৫১টি পরিবারের বসবাস। গ্রামটি দুর্গম এলাকায় হওয়ার কারণে ওই এলাকা দিয়ে কেএনএফ সদস্যরা প্রতিনিয়ত চলাফেরা করত। তাদের এই চলাচলের কারণে গ্রামবাসী আতঙ্কিত হয়ে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। কেএনএফের অত্যাচারে সবাই তটস্থ থাকাদের কেউ কেউ রুমা বাজারে আশ্রয় নিয়েছেন, কোনো কোনো পরিবার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে, আবার কেউ জঙ্গলে লুকিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই ব্যাপারে মারমা ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক সুইপ্রুচিং মার্মা বলেন, শনিবার রাত থেকে আশ্রিতদের সব ধরণের সহযোগীতা করছে সবাই, জেলা প্রশাসন ত্রান বরাদ্ধ দিয়েছে, পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা এখানে থাকবে। রুমা থেকে শৈহ্লাচিং মারমা নামে স্থানীয় একজন জানান, তারা বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আতঙ্কে রুমা সদরে আশ্রয় নিয়েছেন, তবে সেখানে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিদের সাথে সম্পৃক্ততা যেন কেউ না রাখে : বান্দরবানের পুলিশ সুপার বান্দরবানে কেএনএফ এর নিহত সদস্যের নাম বেনেট ম্রো ! নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একজন জানান, ওই গ্রামের এক কারবারীর (পাড়া প্রধান) মেয়ে জামাইকে এক সপ্তাহ আগে কেএনএফ ধরে নিয়ে যায় তথ্য পাচারের অভিযোগে, তাকে মারধর করে আহত অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে রাখে। পরে তাকে উদ্ধার করে গ্রামের লোকজন। এরপর থেকেই ওই গ্রামে লোকজনদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে বাইরে না যাওয়ার হুমকিও দেয় সন্ত্রাসীরা। পরে শনিবার সন্ধ্যায় কেএনএফ শসস্ত্র সদস্যরা অন্য এলাকায় গেলে, সেই সুযোগে মারমা পরিবারগুলো নিজ এলাকা ছাড়তে শুরু করে। ওই ব্যক্তি আরও জানান, পালিয়ে আসা অনেক পরিবার এখনো পাহাড়ের জঙ্গলে রয়েছে। কোনো কোনো পরিবার তাদের নিকট-আত্মীয়দের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছে। বম সম্প্রদায়ের যুবকদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ। মুলপি পাড়ায় ৮০টি বম সম্প্রদায়ের পরিবার থাকলেও তাদের কোনো পরিবার পালিয়ে আসার খবর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি কেএনএফসহ পাহাড়ে গোপনে প্রশিক্ষণরত সন্ত্রাসী ও জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। স্থানীয়রা জানান, গত ১০ অক্টোবর থেকে জেলার রুমা ও রোয়াংছড়ির সীমান্তবর্তী রাঙামাটির বিলাইছড়িতে সন্ত্রাস নির্মূলে অভিযান পরিচালনা করে যৌথবাহিনী। এরপর রুমা উপজেলা থেকে বম সম্প্রদায়ের ৭০টি পরিবারের তিন শতাধিক নারী-পুরুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের মিজোরামে আশ্রয় গ্রহন করে, তারা সেখানে বর্তমান পরিস্থিতির প্রশমনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার মোঃ তারিকুল ইসলাম পিপিএম বলেন, সেনা বাহিনীর সাথে কেএনএফ এর গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ একটি লাশ উদ্ধার করে, এই ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। পাহাড়ের ৯টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় কেএনএফ, গত বছর প্রায় ১ হাজার সদস্য নিয়ে সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। গত ৯ অক্টোবর থেকে র্যাব ও সেনাবাহিনী জেলার রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি ও রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার বড়থলি ইউনিয়নে জঙ্গী বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে। কেএনএফ আস্তানায় জঙ্গী সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার জঙ্গীদের প্রশিক্ষন দিচ্ছে, এমন অভিযোগ রয়েছে। গত ২০ অক্টোবর থেকে সেখান থেকে ৭জন জঙ্গী ও ৩জন কেএনএফ সদস্য এবং ১১ জানুয়ারী আরো ৫জন জঙ্গীকে আটক করে র্যাব। রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মামুন শিবলী বলেন, আশ্রয় নেয়া লোকজনের খবর নেয়া হয়েছে, তাদের সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে, আরও পালিয়ে আসতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, গত ৪ ডিসেম্বর থেকে জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে রোয়াংছড়ি, রুমা, ও থানচি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞার জারি করা হয়, বর্তমানে এই নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। ফলে টানা নিষেধাজ্ঞার ফলে জেলার পর্যটন শিল্প ধ্বংসের মুখে এমন মত পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্টদের।