বান্দরবানে গত তিন দিন ধরে ভারী বর্ষণের কারণে ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে পাহাড়। এর ফলে যেকোন মূহুর্তে পাহাড় ধ্বসে ঘটতে পারে ব্যাপক প্রাণহানি। পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছেন বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত ৩০ হাজার পরিবার।
জানা যায়,বান্দরবান প্রায় প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে টানা ভারি বর্ষনের ফলে বসত বাড়িতে পাহাড় ধসে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে থাকে। প্রাণহানী ও ক্ষয় ক্ষতি এড়াতে ঝুঁকিপুর্ন বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহন করে থাকেন। সরেজমিনে পরির্দশন করে দেখা যায়, বান্দরবান জেলা শহরের ইসলামপুর, লাঙ্গিপাড়া, হাফেজ ঘোনা , কালাঘাটা, বনরূপা, ক্যাচিং ঘাটাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন পাহাড়ের পাদেদেশে ও ঢালুতে ঝুকিঁপুর্ন বসবাস করছে কয়েক হাজার পরিবার।
স্থানীয়দের মতে, প্রতি বছরই শুস্ক মৌসুমে পাহাড় কেটে তারা পাহাড়ের পাদদেশে নতুন নতুন বসত বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। পাহাড়ী জমির মূল্যে সমতল জমির তুলনায় কম হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষরাই পাহাড় কেটে যেখানে সেখানে বসত নির্মাণ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাদদেশে বসবাস করে। আর বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকায় পাহাড় ধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। ফলে মৃত্যু বরনকারীরা বেশির ভাগই হয় নিম্ন আয়ের মানুষ। স্থানীয়রা জানায়, বান্দরবান সদর ছাড়াও জেলার দক্ষিণাঞ্চল লামা, আজিজনগর, ফাসিয়াখালী, ফাইতং, গজালিয়া, রোয়াংছড়ি, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমসসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ের পাঁদদেশে নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। আর মাথাগোঁজার ঠাঁই হিসেবে সেখানে অপরিকল্পিত ভাবে বসতবাড়ী গড়ে তুলেছে হাজার হাজার পরিবার। ফলে সেখানে পাহাড় ধসের ঝুঁকি ও মৃত্যুর সম্ভাবনা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে জানা গেছে, ৭টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ের পাদদেশে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে তুলেছে প্রায় ৩০হাজারেরও বেশি পরিবার। এবছরও পাহাড়ের পাদদেশে নতুন নতুন বসতি গড় উঠায় গত বছরর তুলনায় ঝুঁকিপূণ এলাকা ও পরিবারের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে গেছে। তাদের মতে, শুষ্ক মৌসুমে মৌসুমে উন্নয়নের নামে পাহাড় কেঁটে সেই মাটি দিয়ে বিভিন্ন এলাকার সড়কে সৃষ্ট গর্ত ভরাট, নতুন সড়কে মাটি দেওয়াসহ নানান কাজ করা হয়। এছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কেটে বসত বাড়ি নির্মাণ করে। বর্ষাকালে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে মাটি নরম হয়ে সেই পাহাড়ের কাটা অংশ ধসে গিয়ে ঘরের ওপর আঁছড়ে পড়ে। এতে মাটি চাপা পড়ে প্রাণহানি ঘটে অনেকের। বিগত বছর গুলোতেও এভাবেই পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে অনেকের।
এদিকে, পাদদেশে বসবাসকারীদের মতে, বেঁচে থাকার তাগিদে কয়েকবছর যাবৎ ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাহাড়ের পাঁদদেশে বসবাস করছেন তারা। সরকার প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি শুরু হলেই মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যেতে আহবান করা হয়। তাদেরকে পরবর্তীতে পূর্ণবাসনের আশ্বাসও দেয়া হয় সেসময়। কিন্তু এগুলো মুখে কিংবা কাগজ কলমেই থেকে যায়, বাস্তবে কিছুই হয়না।
বান্দরবান বাসস্টেশন এলাকার কাসেম পাড়ায় পাদদেশে বসবাসকারী মোঃ ইব্রাহিম জানায়, আমার বাড়িটি পাহাড়ের উপরে। যারা নিচে থাকে তারা প্রভাব দেখিয়ে পাহাড়ের মাটি কেটে ফেলায় আমার বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। যেকোন মূহুর্তে আমার বাড়িটি ধসে পড়তে পারে। সে এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারী সহায়তা চেয়েছেন।
এদিকে কালাঘাটার পাহাড় ঝুঁকিতে থাকা মনোয়ারা বলেন, সরকার আমাদের নিরাপদে থাকার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে থাকতাম না। বর্তমানে আমরা অনেকটা বাধ্য হয়েই এখানে বসবাস করছি।
বান্দরবানের মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষন কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো: মাহাবুবুল ইসলাম জানান, বেশি বেশি পাহাড় কাটলে পাহাড়ের উপরের আস্তর সরে গিয়ে ভিতরের নরম অংশ বেরিয়ে আসে। আর এর ফলে ভূমি ক্ষয়ের মাধ্যমে পাহাড়ে ফাটল তৈরি হয় এবং এর ফলেই বর্ষার ভারী বর্ষণে ভূমি ধস হয়। পাহাড় ধসের প্রধান কারণ হচ্ছে নির্বিচারে বক্ষ নিধন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা, প্রাকৃতিকভাবে ভূমিকম্প এবং অতিবৃষ্টি। এসব কারনে পাহাড়ের মাটির গঠন দূর্বল হয়ে যায় বলেও জানান তিনি।
এব্যাপার বান্দরবান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট কায়েসুর রহমান বলেন, বান্দরবানে প্রতিমূহুর্তে বৃষ্টি হচ্ছে। তাই পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে পাদদেশে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে ইতিমধ্যে প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিষ্টেটদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উনারা স্ব স্ব উপজেলা ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাবেন।
সরকারি সূত্র মতে, ২০০৬ সালে জেলা সদরে ৩ জন, ২০০৯ সালে লামা উপজেলায় শিশুসহ ১০ জন, ২০১০ সালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৫জন, ২০১১ সালে রোয়াংছড়ি উপজেলায় ২জন, ২০১২ সালে লামা উপজেলায় ২৮ জন ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১০ জন, ২০১৫ সালে লামায় ৪ জন, সিদ্দিকনগরে ১জন ও সদরের বনরূপা পাড়ায় ২জন, ২০১৭ সালের ১৩জুন সদরের কালাঘাটায় ৭জন ও রুমা সড়কে ২৩ জুলাই ৫ জন এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩জুলাই কালাঘাটায় ১জন ও লামায় ৩ জন, ২০১৯ সালের ১৪জুলাই লামাতে ১জন, ২০২০সালের ১সেপ্টেম্বর আলীকদমের মিরিঞ্জা এলাকায় ১জন ও ২০২১ সালের ১৫সেপ্টেম্বর সাইঙ্গ্যা ঝিরিতে বান্দরবানে একই পরিবারের ৩জন পাহাড় ধসে নিহত হয়। শীগ্রই পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরিয়ে না নিলে পাহাড় ধসে আবারো বড় ধরনের প্রাণহানির মত দূর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।