* সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপ করে দেখাচ্ছে বীরত্ব
* আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায়ও থামছে না দৌরাত্ম্য
কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বাড়ছেই। এরা ছিনতাই, চুরি, হত্যায় পাকা। ফাঁকা বাজার, রাস্তা, ফুটপাত ঘিরে এদের তৎপরতা। রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরে এক গ্রুপের হাতে আরেক গ্রুপের সদস্য খুন হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপ করে নিজেদের বীরত্ব জানান দিচ্ছে। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি ভয়ানক ভিডিও ছেড়ে দিচ্ছে গ্রুপে। দেড় যুগে সহস্রাধিক গ্যাং সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা তৎপরতা রয়েছে। এরপরও এদের দৌরাত্ম্য থামছে না।
পুলিশ ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সূত্রে জানা যায়, নামে কিশোর গ্যাং হলেও এর বেশির ভাগ সদস্য নাবালক। এরাই সন্ত্রাসী-সহিংস কর্মকাণ্ড চালায়। নারী-শিশু উত্ত্যক্ত থেকে শুরু করে পাচারে সম্পৃক্ত এরা। টিকটক সেলিব্রেটি বানানোসহ বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক নির্যাতন, অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে কিশোরীদের ফাঁদে ফেলে। একসময় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পাচারকারীদের হাতে তুলে দেয়।
গোয়েন্দা তথ্যে জানা যায়, কিশোর গ্রুপগুলোর সারা দেশে নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিদেশি অপরাধী চক্রের সঙ্গেও এদের যোগাযোগ রয়েছে। ‘স্টার বন্ড গ্রুপ’, ‘জুম্মন গ্রুপ’, ‘চান-জাদু (যমজ ভাই) গ্যাং’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টি’, ‘ভলিয়ুম টু ও ভাণ্ডারি’সহ বিভিন্ন নামে কিশোর গ্রুপ রয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে এর আগে বরগুনার ‘নয়ন বন্ড গ্রুপ’, ‘পটালী গ্রুপ’ দেশজুড়ে আলোচনায় আসে। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ভাইব্বা কিং গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করেছে। এই গ্রুপের ৯ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
র্যাব জানায়, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৫৭টি অভিযানে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৫ শতাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এই সময়ে সমসংখ্যক কিশোর অপরাধী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সর্বমোট ৩১টি অভিযানে বিভিন্ন গ্রুপের ২৭৭ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এদের অধিকাংশ দিনে সাধারণ শ্রমিকের কাজ করে। রাতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই-সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হয়।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, কিশোর গ্যাং নির্মূল করতে র্যাব দিনরাত সতর্কাবস্থায় রয়েছে। চিহ্নিত হওয়ার পর এরা গ্রেফতার হচ্ছে। ৫ জুন র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার শীর্ষক আলোচনাসভায় বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব থাকবে না।’ ওই অনুষ্ঠানে তিনি এও বলেন, ‘কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অভিভাক, শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
১ জুন রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকায় অন্তর নামে ১৫ বছর বয়সি এক কিশোরকে তারই সমবয়সি কিশোর গ্যাং সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ৬ থেকে ১০ জন কিশোর হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। গেল আগস্টে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায় রিপন নামের এক কিশোর খুন হয়। এর এক মাস পর সানোয়ার হোসেন নামে আরেক কিশোর অন্য গ্রুপের সদস্যদের হাতে খুন হয়। সানোয়ার হত্যার তিন দিন পর পুরান ঢাকার লালবাগের ৪৭/১ ডুরি আঙ্গুলি লেনের ৫ তলা ভবনের ছাদে হাফিজ নামের এক কিশোরকে গলা কেটে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাজধানীর উত্তরায় ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়। ওই সময়েই কিশোর গ্যাং সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানতে পারে। গত বছরের ৩ আগস্ট টিকটক অপু গ্রেফতার হয়। সে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে এক প্রেকৌশলীকে মারধর করে। টিকটকের নায়িকা বানানোর টোপ দিয়ে এসব গ্রুপের সদস্যরা কিশোরীদের ব্ল্যাকমেইল করে, ধর্ষণ করে।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে শুধু রাজধানীতেই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে ৩০ কিশোর খুন হয়েছে। এছাড়া কিশোর গ্রুপের আধিপত্য বিস্তার, পথচারীদের হঠাৎ ঘিরে ধরে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়া, রাস্তায় পরিকল্পিত সংঘাত তৈরির মাধ্যমে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজির মতো ঘটনা প্রায় ঘটছে। শুধু রাজধানী কিংবা বিভাগীয় শহরে নয়, পাড়াগাঁয়েও কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। খেলার ছন্দে অনেক কিশোর সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে। পুলিশ অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাচ্ছে। গ্রেফতারও হচ্ছে। কিন্তু কিশোর অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ফারুক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কিশোর গ্যাং সদস্যরা ভয়ানক অপরাধ করে চলেছে। এদের শুধু গ্রেফতার কিংবা বিচারের আওতায় এনে সমাজ থেকে হিংস কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যাবে না। পুলিশ অভিযোগ তথা নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করছে। কিন্তু গ্যাং কালচার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে পরিবার-সমাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশায় জড়িত সচেতন মহল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি কিশোররা কী ধরনের ভয়ানক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে। কিশোররা দিনের আলোয় মানুষ খুন করছে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করছে। যোগাযোগ মাধ্যমে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ভিডিও বানাচ্ছে। নেট দুনিয়ায় তা ছেড়ে দিচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সাবিনা শরমিন ‘ডাইনামিকস অব জুভেনাইল ডেলিনকোয়েন্সি অ্যান্ড ইটস লিগ্যাল ইমপ্লিকেশন, অ্যান অ্যানথ্রোপলজিক্যাল স্টাডি’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণায় উঠে আসে-পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধুবান্ধব কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে জানান, কিশোর গ্যাং সদস্যরা অনেক ক্ষেত্রেই ভয়ানক। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ চুপ থাকে। সমাজের মানুষকে সম্মিলিতভাবে এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। এদের ধরিয়ে দিতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে সহযোগিতা করতে হবে। কারণ খুদে কিশোররাই হত্যাসহ বড় ধরনের অপরাধ করতে পারে। এদের দ্বারা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নয়, সামাজিক দায়বন্ধতা থেকেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা সর্বদা সতর্কাবস্থায় আছি। প্রয়োজন সচেতনতার।