চাঁদাবাজি ও অপহরন বানিজ্যকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলায় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে জেএসএস,ইউপিডিএফ,জেএসএস (এমএন লারমা),ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রীক) ও মগ লিবারেশন পার্টির শসস্ত্র ক্যাডারদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে গত তিন বছরে শুধু বান্দরবান জেলায় খুন হয়েছে অন্তত বিশ জন।
এসব শসস্ত্র সংগঠনের ক্যাডাররা প্রতি বছর তিন পার্বত্য জেলা থেকে চাঁদা উত্তোলন করছে অন্তত পাঁচ শত কোটি টাকা। জানা যায়,পার্বত্য তিন জেলাকে নিয়ে একটি স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড গঠন এবং শায়িত্ব শাসনের দাবিতে সরকারের সাথে বিরোধে জড়িয়ে ১৯৭৩সালে নিহত মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল শান্তি বাহিনী নামে একটি শসস্ত্র সংগঠন। শান্তি বাহিনী নামে এই গেরিলা সংগঠন গঠন করার পর স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড গঠন এবং শায়িত্ব শাসনের দাবি নিয়ে প্রকাশ্যে তারা মাঠ পর্যায়ে কোন আন্দোলন সংগ্রাম না করলেও ব্যস্থ হয়ে পড়ে চাঁদাবাজি,খুন,গুম ও অপহরন বানিজ্যে।
আশির দশকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলে রুপান্ত করে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমাকে সভাপতি করে দলের নাম করন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) । অঞ্চলিক রাজনৈতিক দল গঠন করে স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড গঠন এবং শায়িত্ব শাসনের দাবিতে দলের রাজনৈতিক শাখা মাঠে আন্দোলন সংগ্রামসহ সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে গেলেও দলের শসস্ত্র শাখা তথা শান্তি বাহিনী অব্যাহত রেখে ছিল খুন,চাঁদাবাজি ও অপহরন বানিজ্যে।
১৯৮৩ সালে নিজ দলের কর্মীর হাতে দলের প্রতিষ্টাতা সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা খুন হলে দলের হাল ধরেন তার আপন ছোট ভাই জ্যোতিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা। পরিশেষে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর তৎকালীন আ'লীগ সরকারের সাথে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির ৭২টি শর্ত নিয়ে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সন্তু লারমাসহ শান্তি বাহিনীর কয়েক হাজার শসস্ত্র ক্যাডার অস্ত্র সর্মপনের মধ্য দিয়ে শান্তি বাহিনী নামক তাদের শসস্ত্র শাখাটি বিলুপ্ত ঘোষনা করে। এই দিন সন্তু লারমাকে বিশ্বাস ঘাতক আখ্যায়িত করে জেএসএস এর বিশাল একটি অংশ প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে আরেকটি শসস্ত্র সংগঠন। তারাও জেএসএস এর পদাঙ্ক অনুসরন করে স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড গঠন এবং শায়িত্ব শাসনের দাবিতে আন্দোন সংগ্রাম থেকে লাইনচ্যুত হয়ে ব্যস্থ হয়ে পড়ে চাঁদাবাজি,খুন,গুম ও অপহরন বানিজ্যে। পরর্বতীতে চাঁদাবাজি ও অপহরন বানিজ্যকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জেএসএস - ইউপিডিএফ এর মধ্যে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে। পাহাড়ে চাঁদাবাজি ও অপহরন বানিজ্যের মধ্য দিয়ে খুব সহজে ব্যাপক অর্থ আয়ের সুযোগ থাকায় ক্রমান্বয়ে জেএসএস ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে নতুন নতুন শসস্ত্র দল।
শান্তি চুক্তির পর জেএসএস ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে ইউপিডিএফ। ২০০৫ সালের দিকে জেএসএস আরেক দফা ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে জেএসএস সংস্কার(এমএন লারমা)।২০১৯ সালের দিকে শুধু মাত্র বান্দরবান জেলা হঠাৎ গড়ে তোলা হয় মগ লিবারেশন পার্টি নামে আরেকটি শসস্ত্র সংগঠন। ২০২০ সালের দিকে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে ইউপিডিএফ (গনতান্ত্রীক)। বর্তমানে এই পাঁচটি শসস্ত্র সংগঠনের ক্যাডারদের মিশন ও ভিশন এক ও অভিন্ন। এসব দলের সদস্যদের হাতে রয়েছে সর্বাধুনিক বিদেশী তৈরী ভারী অস্ত্র ও গোলা বারুদ। পাবর্ত্য রাঙ্গামাটির পুর্ব সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে মিজুরামে ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে এসব সন্ত্রাসীদের রয়েছে সামরিক প্রশিক্ষন ঘাটি। আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির দ্বন্দ্বে গত তিন বছরে বান্দরবানে এই পাঁচটি শসস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে জড়িয়ে নিহত হয়েছে ২০জনেরো অধিক।
স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা সুত্রে জানা যায়,২০১৯ সালের ৭ মে মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যরা জনসংহতি সমিতির কর্মী বিনয় তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে। অপহরণ করা হয় ফোলাধন তঞ্চঙ্গ্যা নামের অপর কর্মীকে। এখনও তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৯ মে জনসংহতি সমিতির সমর্থক জয় মনি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ১৯ মে জেএসএস সদস্যরা রাজবিলায় আওয়ামী লীগের সমর্থক ক্য চিং থোয়াই মারমা (২৭)কে অপহরণের পর গুলি চালিয়ে হত্যা করে।
২২ মে রাতে জেএসএস এর সদস্যরা আ'লীগ নেতা চথোয়াইমং মারমাকে বালাঘাটার চড়ুইপাড়া এলাকা থেকে অপহরণের পর হত্যা করে। ২৫ জুন রোয়াংছড়িতে আওয়ামী লীগ কর্মী অংসিচিং মারমাকে গুলি করে হত্যা করে হত্যা করা হয়। ২২ জুলাই রোয়াংছড়ির শামুকঝিড়ি এলাকায় জেএসএস সদস্যরা তারাছা ইউনিয়ন আ'লীগের সভাপতি মংমং থোয়াই মারমাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল জেএসএস মুল দলের সদস্যরা রোয়াংছড়ি উপজেলার কানাইজোপাড়ায় জেএসএস সংস্কাপন্থী এমএন লারমা গ্রুপের ৬ নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ১৫ মে জেএসএস সদস্যরা রুমা উপজেলার গালেগ্যা ইউনিয়নের দুই বোট চালককে অপহরণের পর লাশ গুম করে। ২ জুলাই রুয়াল লুল থাং বম (৩০)-কে বান্দরবান সদর ইউনিয়নের হেব্রনপাড়া থেকে অপহরণ করা হয়। এখনও তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৬ জুলাই গুংগা জলি ত্রিপুরা ( ৪১) নামে এক যুবককে কুহালংয়ের ১নং এলাকা থেকে জেএসএস সদস্যরা অপহরন করে। ১ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের বাঘমারায় জেএসএস সদস্যেদর গুলিতে নিহত হয় মংসিং উ মারমা। ১৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রোয়াংছড়ির নতুন পাড়ায় সাবেক মেম্বার ছাউপ্রু (৫০) মারমাকে গুলি করে হত্যা করেছে মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যরা।
২০২১ সালের ১৮জুন বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে মসজিদের ইমাম নওমুসলিম মোঃ ওমর ফারুককে(৫০) ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে জেএসএস সদস্যরা। একই বছরের ১৯ জুলাই বান্দরবান সদরের ক্যামলং পাড়ায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ও পল্লী চিকিৎসক অং ক্য থোয়াই (৪২) কে অপহরণের পর হত্যা করে জেএসএস সদস্যরা। ২৩ নভেম্বর রোয়াংছড়ির তালুকদার পাড়ার উথোয়াইনু মারমাকে গুলি করে হত্যা করে জেএসএস সদস্যরা।
সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর বান্দরবান সদরের ডলু পাড়া নিজ বাসা থেকে জেএসএস এর সদর উপজেলা শাখার সাধারন সম্পাদক পুশেথোয়াই মারমাকে মগ লিবারেশনর পার্টির সদস্যরা অপহরেনর পর গুলি করে হত্যার পর লাশ আমতলী এলাকায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলে। চাদাঁবাজি ও অপহরন বানিজ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে ভ্রাতৃঘাতি সংঘতে বান্দরবান পার্বত্য জেলায় প্রতি নিয়ত খুন,অপহরন ও গুমের ঘটনায় খালি হচ্ছে মায়ের কোল,বিধবা হচ্ছে মা বোন এবং পিতা হারা হচ্ছে অনেক নারী পুরুষ। এসব শসস্ত্র সন্ত্রাসী দল গুলোর ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত ও চাঁদাবাজি এবং নিরীহ মানুষকে গুম খুনের ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে পার্বত্য এলাকার উন্নয়ন এবং সার্বক্ষনিক আতংকিত অবস্থায় দিন যাপন করছে উপজাতি-বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের সাধারন মানুষ। তাদের দাবী প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে এসব সন্ত্রাসী দল গুলোকে নির্মুল করে ২০২২ সালে পাবর্ত্যাঞ্চল যেন হয় নিরাপদ একটি আবাসস্থল।