আজ রবিবার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আলীকদমে আখ চাষে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকরা স্বাবলম্বী

সুশান্ত কান্তি তঞ্চঙ্গ্যাঁ, আলীকদম (বান্দরবান) : | প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৭:০০ অপরাহ্ন | পার্বত্য চট্টগ্রাম

বান্দরবানের আলীকদমে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর সহযোগিতায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ -এর আওতায় তামাক চাষের বিকল্প ইক্ষু চাষ শুরু করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণসহ সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ প্রকল্পের অধীনে ১২৪ জন কৃষকের মাধ্যমে ১২৪টি প্লটের মাধ্যমে ১২৪ বিঘা জমিতে ইক্ষু চাষ করা হচ্ছে।

 

 

অত্র উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২৩-২০২৪ রোপণ মৌসুমে ৬৪ টি জন কৃষকদের মাঝে ৬৪ বিঘা জমি এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬০টি প্রদর্শনী প্লট প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষের প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ইক্ষু চাষ হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৪৬ টি এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ৮০টি  আখ চাষের প্লট তৈরি করা হয়েছে। 

 

 

প্রদর্শনী প্লট সমূহে উন্নতমানের শোধনকৃত আখের বীজ, সাথী ফসলের বীজ,সার-কীটনাশক বিতরণ এবং প্রদর্শনী প্রাপ্ত কৃষক ও অন্যান্য কৃষকদের কে যথাসময়ে মাঠ দিবসসহ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রশিক্ষিতও করে গড়ে তুলা হয়। চলতি মৌসুমে এ চাষে বাম্পার ফলনে লাভের মুখ দেখা দেওয়ায় চাষিরা বেজায় খুশি।স্বল্প খরচ,অধিক লাভ ও পরিশ্রমও কম হওয়ার কারণে বর্তমানে অন্য কৃষকেরাও আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠছেন।সচেতন মহলের অভিমত,তামাকের বিকল্প হতে পারে আখ চাষ। তাই এ চাষ বৃদ্ধিতে কৃষি বিভাগকেও কৃষকদের সহায়তা প্রদান অপরিহার্য। চলতি মৌসুমে ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে ১২৪ জন প্রকৃত তামাক চাষিকে ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত চার যুগের বেশি সময় ধরে আলীকদম উপজে ৪টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় আবাদি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ হয়ে আসছে। বর্তমানেও বেশির ভাগ জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। তামাক চাষ লাভবান হলেও শারীরিকভাবে ক্ষতি হয়। এছাড়া পরিশ্রম এবং মূলধন বেশি লাগার কারনে আস্তে আস্তে অনেক কৃষকই সম্প্রতিকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উদ্বুদ্ধকরণে ক্ষতিকর তামাক চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তারা তামাকের বিকল্প বেচে নিচ্ছেন আখ চাষকে। এক সময় যে সকল কৃষক ক্ষতিকর তামাক চাষ করতেন তাদের অনেকেই এখন আখ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন বলে জানান কৃষি বিভাগ।

 

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানায়, কৃষকদের তামাক চাষ থেকে ফেরাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সার্বিক সহযোগিতায় ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ -এর আওতায় ২০২৩-২৪ ও ২০২৪-২৫ রোপন মৌসুমে আলীকদম উপজেলায় ১২৪ জন কৃষকের মাধ্যমে বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস),বিএসআরআই আখ ৪১ (অমৃত), বিএসআরআই আখ ৪৭,চায়না,সেনেগাল, ব্ল্যাক রুবি ও ভিএমসি ৮৬-৫৫০ জাতের আখ চাষ দেওয়া হয়। প্রতিজন কৃষক ১ বিঘা হারে এ চাষ করা হয় ১২৪ বিঘা জমিতে। আবার এ সকল চাষীরা আখ ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে আলু, মুলা,গাজর ও ফরাশ সিম, বাঁধাকপি,শাক, ফুল কপিসহ আরো কয়েকটি ফসল চাষ করেন। এতে আখের চারা,সার,কীটনাশক ও পানি সেচসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ।

 

 

সূত্রটি আরও জানায়,মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার ফলাফল অনুযায়ি প্রতি বিঘা ইক্ষু ও সাথী ফসল চাষ করে নীট লাভ হিসেবে কৃষক পাচ্ছেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। অপর দিকে প্রতি বিঘা তামাক চাষ করে নীট লাভ হিসেবে কৃষক পাচ্ছেন ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা। লামা ও আলীকদম উপজেলায় ১ হাজার ৪৪০ টন সহ জেলার ৭টি উপজেলায় সর্বমোট ৫২ হাজার ৮০০টন আখ উৎপাদন হয়েছে বলেও জানান সূত্রটি।

 

 

এ বিষয়ে‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ এর জুনিয়র কনসালটেন্ট বসন্ত কুমার তঞ্চঙ্গা জানায়, আলীকদম উপজেলায় ২ অর্থ বছরে ১২৪ জন কৃষকের মাধ্যমে ১২৪ বিঘা জমিতে এ বছর আখ চাষ করানো হয়। ইতিমধ্যে উপকারভোগী চাষিদেরকে প্রশিক্ষণ, সার, চারা, কীটনাশক ও সেচের জন্য নগদ অর্থও প্রদান করেছি। এতে চিবিয়ে খাওয়াসহ গুড় জাতের আখ রয়েছে। এক বছর বীজ লাগালে আখ কাটার পর তা থেকে ৩ বছর পর্যন্ত আখ পাওয়া যায়। উদ্বুদ্ধকরণ ও এ চাষে লাভবান হওয়ায় আগামী ২০২৫--২৬ অর্থ বছরে চাষীর সংখ্যা প্রায় তিনগুন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।

 

 

২নং চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সংলগ্ন আবুল হাসেম এর আখ ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সাজানো গোচালো আখ। সেগুলো তিনি আখ ক্ষেতের পরিচর্যা করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় ১ বিঘা জমিতে রং বিলাস-৪২, বিএসআরআই আখ ৪২ (রংবিলাস), বিএসআরআই আখ ৪৭, সেনেগাল ও ব্ল্যাক রুবি জাতের এ আখ চাষ করেছেন। তার ক্ষেতে প্রায় ৫ হাজার পিচ আখ রয়েছে। এতে আনুমানিক খরচ হয়েছে ৫০/৬০ হাজার টাকা। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রতি পিচ আখ ৪০/৪৫ টাকা হারে আখ বিক্রি করে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা পাবেন।তিনি আরও বলেন, আগে এ জমিতে তামাক চাষ করে খরচ বাদ দিয়ে ৫ হাজার টাকাও লাভ করতে পারতেন না। সাথী ফসল হিসেবে আখের ফাঁকে ফরাশসিম, মুলা, বাদাম ও গোল আলু চাষও করেছেন তিনি। এ সাথী ফসল থেকে তিনি আরও প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় করেছেন।

 

 

 আখ চাষী মোঃ আজিম উদ্দিন বলেন, এবার আমি নিজস্ব ১ বিঘা জমিতে রং বিলাস ৪২ জাতের আখ চাষ করেছি। আখের চাহিদা থাকায় ভালো দাম পাচ্ছি এবং বাহিরে ব্যবসায়ীরা পাইকারি নিয়ে যাচ্ছেন।তিনি আরও বলেন, আখ চাষে সব মিলিয়ে খরচ প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে আখ বিক্রি করে ১ লাখ ৮০ টাকা পেয়েছি। এতে আমার ১ লাখ ১০ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। এছাড়া সবজি চাষ থেকেও ২০ হাজার টাকা আয় করতে পেরেছি।

 

 

এদিকে সিরাজ কারবারি পাড়ার বাসিন্দা খুচরা আখ ব্যবসায়ী আবু ছিদ্দিক বলেন, প্রতি শত আখ ৬ হাজার টাকা হারে ক্রয় করে সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তিনি।

 

 

এদিকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপার ক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ প্রকল্প’ এর কনসালটেন্ট কৃষিবিদ ক্যছেন বলেন,আখ অর্থকরী ফসল। এক সময় দেশে ধানের ফলন বৃদ্ধির জন্য আখ চাষ কমে এসেছিল,কিন্তু বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় আখ চাষের কারণে এ চাষে কৃষকদের সু-দিন ফিরে আসছে। অনেক কৃষকই বর্তমানে আখ চাষ করে আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন,বান্দরবানের প্রতিবছর গুড়ের চাহিদা ৩০ থেকে ৩২ টন কিন্তু এ জেলায় স্থানীয়ভাবে গুড় উৎপাদিত হয় শুধুমাত্র ২ থেকে ৪ টন। বাৎসরিক গুড়ের চাহিদা মেটানোর জন্য আরো ২৬ থেকে ২৮ টন প্রয়োজন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু চাষ সম্প্রসারণে সুস্থু পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

 

 

পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট এর বাস্তবায়নাধীন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুগারক্রপ চাষাবাদ জোরদার করণ’ প্রকল্পটি একটি উপযুক্ত কার্যকরী পদক্ষেপ আখ্যা দিয়ে আলীকদম উপজেলা কৃষিবিদ কর্মকর্তা মোঃ সোহেল রানা জানিয়েছেন,ইক্ষু থেকে নগদ অর্থ উপার্জন করা সম্ভব। আলীকদমে আবাদযোগ্য পতিত জমি এবং এক ফসলী উঁচু জমি খুব সহজেই স্বল্প সেচের মাধ্যমে আখ চাষের জন্য উপযোগী এবং অধিক সম্ভাবনাময়। বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারভূক্ত কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো এ উপজেলার কার্যক্রম আরো জোড়ালো,নিবিড় ভাবে পরিচালনা ও ত্বরান্বিত করার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।