চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: থিক নাথ হানের লেখা হাউ টু ওয়াক, ভিক্টর ই. ফ্রাঙ্কল এর ম্যান’স সার্চ ফর মিনিং এবং এরিক জর্জেনসন এর দ্য আলমানাক অব নাভাল রাভিকান্ত- বিশ্ববিখ্যাত এ তিনটি গ্রন্থের ভাবানুবাদ করেছেন রিয়াজ মোরশেদ সায়েম। এবার অমর একুশে বইমেলায় ঘুরে বইগুলো কিনেছি বসন্তের প্রথম দিন পহেলা ফাল্গুন।
ভাষার মাস উপলক্ষে আয়োজিত একটি কুইজ প্রতিযোগিতার পুরস্কার হিসেবে মেলায় হেঁটে হেঁটে লেখক বন্ধু মাহবুব এ রহমানের সঙ্গে বাছাই করা এসব বই। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি রাত জেগে বইগুলোকে র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে পুরস্কারের জন্য প্রস্তুত করি। সঙ্গে ছিলো আরও তিনটি সাধারণ জ্ঞানের পকেট বই। সেগুলোকেও মুড়িয়ে নিলাম সুন্দরভাবে।
পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭টায় আমরা চারজন ক্যাম্পাস থেকে এবং তিনজন শহর থেকে রওনা হয়েছি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। সাতজনের ছোট্ট একটি দল আমাদের। সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সবার বাড়ি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের পরিচয় কবিরহাট উপজেলা স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সুবাদে।
সে যাই হোক, আমাদের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা একসঙ্গে ঘোরার। ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে কাপ্তাই লেক ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি আমরা। চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এসে সকালের নাস্তা সেরে হাঁটছিলাম বাস টার্মিনালের দিকে। পথিমধ্যে সেল্ফি তুলে ভ্রমণ শুরুর সময়টা ফ্রেমবন্দি করে নিচ্ছে সবাই। টার্মিনাল থেকে টিকিট কেটে বাস ছাড়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। বসে থাকার চেয়ে সবাই ড্রেস পরিবর্তন করে নিলাম। অ্যাসোসিয়েশনের টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে ট্যুরের ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম বাসের সামনে। ছবি তুলতে তুলতে ততক্ষণে বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছে গেলাম কাপ্তাই লেকের একদম কাছেই। এরপর একটু সামনে হাঁটলেই সারি সারি নৌকা। দরদাম করে পাঁচ ঘণ্টার জন্য একটি নৌকা ভাড়া করলাম। দুপুরের খাবার নিয়ে নৌকায় উঠেছি সবাই। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত চোখজুড়ানো কাপ্তাই লেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি এগিয়েই চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অপরূপ দৃশ্য আর বিশুদ্ধ বাতাসে নিজের সব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দেওয়া যাবে এই মৃদু-স্বচ্ছ বাতাসে।
বিশালাকৃতির কাপ্তাই লেক সৃষ্টির ইতিহাসটা অনেকের মত আমারও জানা ছিলো না। উইকিপিডিয়ার সাহায্যে জানতে পারলাম সেটা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত এ লেকটি সৃষ্টি হয় ১৯৫৬ সালে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে গিয়ে এ হ্রদ সৃষ্টি হয়। এতে মানুষের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও ধীরে ধীরে জায়গাটি পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে ওঠে। বর্তমানে লেকের মাঝে থাকা ছোটো ছোটো দ্বীপগুলো লেকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। তাই ঘুরতে এলে দর্শনার্থীরা এসব দ্বীপে নেমে কেউ ছবি তোলেন আবার কেউ গোসলও সেরে নেন।
এখানকার মানুষ কাপ্তাই লেকের পানি সরাসরি পান করেন। নৌকা চালকের এমন কথা শুনে লেকের পানি খেতে ইচ্ছে করছিলো। তাই একটি দ্বীপের পাশে নৌকা থামিয়ে গোসল করার সময় কাপ্তাই লেকের পানির স্বাদ নিলাম। সত্যিই পরিচ্ছন্ন খাবার উপযোগী পানি। পানির স্বাদ অনেকটা টিউবওয়েলের পানির মতোই।
নৌ-বিহারে কিছু ছবি তুলে এবং নামাজ শেষে ফেরার পথে সবার জন্য কিনে নিয়েছি ছোটো ছোটো অনেকগুলো আনারস। আনারসের গন্ধে ম-ম করছিলো পুরো নৌ-বিহারের প্রবেশ পথ। সেখানে দর্শনার্থীদের কাছে কেটে কেটে আনারস বিক্রি করছিলো বিক্রেতারা। মাত্র ১০ টাকায় খাঁটি আনারসের স্বাদ নিতে অনেকেই লাইন ধরে কিনছিল। কেউ আবার বাড়ির জন্যও নিয়ে যাচ্ছিলো এ আনারস।
নৌকায় উঠে সবাই লবণ মরিচের সঙ্গে আনারসের দারুণ স্বাদ উপভোগ করছিলাম। এছাড়া কুইজ এবং র্যাফেল ড্রয়ের পুরস্কার বিতরণের কাজটাও ততক্ষণে সেরে ফেলেছি। নৌকার ছাদে বসে গান ধরেছে নূর ইসলাম বিপ্লব। সঙ্গে ভাঙা গলায় নিজেও তাল মিলাচ্ছিলাম। ইরফান, নজরুল, তারেক এবং জিহানরাও আমাদের সঙ্গে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে। ওইদিকে তুষার শুভ পুরোদিন ফটোগ্রাফার হিসেবেই নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কখনো গানের ভিডিও আবার কখনো আড্ডার দৃশ্যগুলো ফ্রেমবন্দি করে রাখছে শুভ।
বিকাল ৫টার মধ্যে বাস টার্মিনালে পৌঁছাতে হবে আমাদের৷ অন্যথায় আজ আর ফেরা হবে না। তাছাড়া রাত্রিযাপনের জন্য কাপ্তাইয়ের আশেপাশে ওরকম কোনো হোটেলও নেই। তাই কাপ্তাই ঘুরতে এলে দিনে এসে দিনেই ফিরতে হয়। নৌকায় ওঠার আগে বিকেল পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে উঠেছি আমরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক পাঁচটায় টার্মিনালে পৌঁছালাম সবাই। বাসে ওঠার আগে আরও একবার ট্যুরের ব্যানার নিয়ে ছবি তুললাম।
সারাদিনের ক্লান্তির ঘুমটা বাসের মধ্যেই ঘুমাচ্ছে সবাই। দুই ঘণ্টার যাত্রা ঘুমের মধ্যেই কেটে গেছে। বহদ্দারহাট নেমে হোটেলে বসে বিকালের নাস্তা করার সময় ভ্রমণের অনুভূতি শেয়ার করছে সবাই। ততক্ষণে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে যাওয়া রাতের সর্বশেষ শাটল ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। এবার বাসায় ফেরার পালা। রাত সাড়ে ৮টার শাটল ট্রেনে ক্যাম্পাসে ফিরেছি আমরা। বাকিরা শহরে ফিরেছে নিজ নিজ বাসায়। নীড়ে ফিরে হিসাব করে দেখলাম- সারাদিন কাপ্তাই লেক চষে বেড়ানো প্রাণবন্ত ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ হয়েছে মাত্র ৯৬৫ টাকা।