সপ্রিতির বাংলাদেশের চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডিভিশনের পোলো গ্রাউন্ড,- আমাদের আগরতলার আস্তাবল ময়দানের প্রায় পাঁচ ছয়গুন বড় একটি মাঠ। সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিশাল বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, প্রধানমন্ত্রীর জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, লক্ষ লক্ষ মানুষ একত্রিত হয়। কিন্তু সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান এই বিশাল মাঠে এর আগে অনুষ্ঠিত হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় সংগঠন এত বড় মাঠে আয়োজন করার কথা কল্পনাও করেনি। পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্য্যদেব যখন বাংলাদেশের গুরুভাইদের আদেশ করলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় উৎসব খুব বড় করে অনুষ্ঠিত করার,- তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন,- এই পোলো গ্রাউন্ডেই এইবার ঠাকুরের জন্মমহোৎসব পালন করবেন। কিন্তু এই মাঠ ব্যাবহার করার খরচ যেমন বিশাল,- তেমনি কতৃপক্ষের কাছ থেকে এই মাঠ ব্যাবহারের অনুমতি পাওয়াও খুব কঠিন। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও মাঠ পাওয়া যাচ্ছিলনা। শেষে আচার্য্যদেবের একান্ত দয়ায় অদ্ভুতভাবে এই মাঠের অনুমতি প্রাপ্ত হয়। সবাই যখন চেষ্টা করে করে বিফলমনোরথ, - সেই মুহুর্তে একজন মুসলিম গুরুভাই এগিয়ে আসেন,- যিনি এই মাঠের কতৃপক্ষের অফিসে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। উনার একান্ত সহায়তায় মাঠ পাওয়া যায়। উৎসব কমিটির সভাপতি শ্রদ্ধেয় প্রদীপদা বলছিলেন,- যে মানুষ অন্যসময় একশ টাকার বেশী অর্ঘ্য দিতে ইতস্তত করতেন,- এমন অনেকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাঁচ দশ হাজার টাকা অর্ঘ দিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় যেসকল গুরুভাইদের মধ্যে মনোমালিন্য ও মতভেদ ছিল,- সেইসকল গুরুভাইরা সকল মতভেদ ভুলে একসাথে দিবারাত্র কাজ করেছেন, এই উৎসবকে সফল করার জন্য। আচার্য্যদেবের প্রতি তাদের আনুগত্য ও ভালবাসা সকল মনোমালিন্য দূর করে দেয়। সবাই এক দিব্য আনন্দে মেতে উঠে। আমার সবচেয়ে আনন্দ হয়েছে,- এত এত যুবক গুরুভাইদের আন্তরিক অংশগ্রহন ও দায়ীত্বশীলতা। শ্রদ্ধেয় প্রদীপদার নির্দেশনায় তারা সকলেই সম্মিলিতভাবে কাজ করে চলেছে নিরবভাবে। ভয় ছিল,- এত বড় মাঠ ভরবে কিনা!! এত মানুষ হবে কিনা!! উৎসবের আগেরদিন থেকেই বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হতে অনেক অনেক গুরুভাই ও মায়েরা বাস রিজার্ভ করে উৎসবের উদ্দেশ্যে রউয়ানা হয়। শ্রদ্ধেয় রঞ্জনদা বলছিলেন,- উনার ফটিকছড়ি এলাকা থেকে পাঁচটি বাস রিজার্ভ করে উৎসবে আসবে। কিন্তু উৎসবের আগের দিন জানালেন,- পাঁচটির জায়গায় দশটি বাস আসছে। এমনিভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রত্যাশার বাইরে জনসমাগম হতে থাকে। উৎসবের দিন দুপুরের আগেই মাঠ ভরে যায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজন অবাক হয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের দ্বারা আয়োজিত এত বিশাল আয়োজন ও এত বড় জনসমাগম এর আগে তারা কেউ দেখেনি। বাজারে রাস্তায় সবাই বলাবলি করছিল। সৎসঙ্গের এই জোয়ার দেখে সকলেই মুগ্ধ হয়ে যায়। শ্রদ্ধেয় প্রদীপদা বলছিলেন,- এই উৎসব করতে গিয়ে প্রতি পদে পদে আচার্য্যদেবের দয়া অনুভব করছি। তিনিই অলক্ষে থেকে এই উৎসবের সকল ব্যাবস্থাপনা করছেন। শ্রদ্ধেয় বলরামদা'র সংগীতানুষ্ঠান এই উৎসবে এই দারুন মাধুর্য দিয়েছে। উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে উনার সংগীত উপভোগ করেছে। দুপুর থেকে রাত নয়টা অব্দি অবিরামভাবে হাজার হাজার মানুষ প্রসাদ গ্রহন করেছেন। বহু মুসলিম মায়েরা ভাইরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবে এসে প্রসাদ গ্রহন করেছে। এই উৎসব শুধুমাত্র সংখ্যালঘুদের উৎসব রইলনা। সকল সাম্প্রদায়িক বিভেদ একাকার হয়ে যায়। ধর্মসভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রীমৎ স্বামী সুদর্শনানন্দ পুরী মহারাজ, মোহান্ত মহারাজ,-ঋষিধাম বাঁশখালী ও তুলসীধাম নন্দনকানন চট্টগ্রামের কর্নধার। বাংলাদেশে প্রতি চার বছর পরপর যে সুবিশাল কুম্ভমেলা অনুষ্টিত হয়,- তিনি এই কুম্ভমেলার আয়োজক ও বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ( প্রায় শতবর্ষ আয়ু) ঋষি। উপস্থিত ছিলেন শ্রী সুকুমার চৌধুরী, সভাপতি, শ্রীশ্রীজন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদ বাংলাদেশ এবং শ্রী অনুপ কুমার দাস, সাধারণ সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ঋষি কুম্ভমেলা উদযাপন পরিষদ। এছাড়া ছিলেন সৎসঙ্গ বাংলাদেশের সভাপতি মহোদয়, পন্ডিত বলরাম দাস, সৎসঙ্গ বাংলাদেশের সহ-সভাপতি শ্রদ্ধেয় প্রদীপ দেব ও আরো অনেক মান্যগণ্য ব্যাক্তিগন। উপস্থিত সুবিশাল জনতা ধর্মসভার গাম্ভীর্য বজায় রেখে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে শ্রবন করেছেন। অনেক ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ, সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ সরকারের অফিসিয়াল ব্যাক্তিগন এই ধর্মসভা শ্রবন করতে উপস্থিত ছিলেন। সর্বোপরি চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের গুরুভাই ও মায়েদের আতিথেয়তা, আপ্যায়ন, ভালবাসা এবং আচার্য্যদেবের প্রতি তাদের অকৃত্রিম আনুগত্য আমায় ভীষণভাবে আপ্লুত করল। আমি ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত হলাম,- তাদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করলাম,- কেমনভাবে সকল প্রতিকূলতাকে দূরে সরিয়ে ইষ্টকাজ করতে হয়, কেমন ভাবে এক আদেশে চলতে হয়। চট্টগ্রামের এই বিভাগীয় উৎসব বাংলাদেশ সৎসঙ্গের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। আমার বিশ্বাস,- পরমপূজ্যপাদ আচার্য্যদেব অত্যন্ত প্রীত হবেন তাদের এই আয়োজনে। পরমপিতার আশীর্বাদ তাদের সকলের জীবনে বর্ষিত হোক- আমার প্রার্থনা। আমার সারাজীবনের এক অমূল্য স্মৃতি হয়ে থাকবে এই উৎসব এবং বাংলাদেশের গুরুভাইদের এই আন্তরিক ভালবাসা ও আপনকরা ব্যাবহার। সূত্র -উৎসব কমিটির সভাপতি শ্রদ্ধেয় প্রদীপদা।