বেলা ১১টা। চট্টগ্রাম নগরের জামালখান খাস্তগীর স্কুল মোড়। আশপাশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের কেউ স্কুলে যাচ্ছে, কেউ ফিরছে। অসংখ্য গাড়ি মোড়ে জটলা পাকিয়েছে। যে যার মতো হর্ন দিচ্ছে। অথচ ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট এই স্পটটি ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
শুধু খাস্তগীর স্কুল এলাকা নয়, ওই সময় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এলাকাকেও ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে কোনো এলাকায়ই কমেনি শব্দদূষণ। নীরব এলাকা ঘোষণাই হয়েছে শুধু। বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই। এ নিয়ে কারও কোনো বিকার নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ঝোলানো ‘নীরব এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ড চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ফটকে থাকলেও খাস্তগীর স্কুলের সামনেরটি উধাও হয়ে গেছে।
খাস্তগীর স্কুল এলাকায় কথা হয় গৃহিণী রায়হানা বেগমের সঙ্গে। জামালখান এলাকার সেন্ট মেরিস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তার ৯ বছরে মেয়ে। বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিতে এসেছিলেন তিনি।
রায়হানা বেগম বলেন, এখানে আশপাশে চার-পাঁচটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। গাড়ির অসহনীয় হর্নের কারণে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতেও কষ্ট হয়। অথচ এখানে কয়েক মাস আগে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ‘নীরব এলাকা’ করা হয়েছিল। কার কথা কে শোনে? যেসব গাড়ি হর্ন দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখিনি।
শুধু গাড়ি নয়। এই এলাকায় শব্দদূষণ হয় উচ্চ শব্দের সাউন্ড সিস্টেম থেকেও। স্থানীয়দের অভিযোগ, জামালখান খাস্তগীর স্কুলের সামনের এলাকাটি নীরব এলাকা ঘোষণা দেওয়া হলেও জনপ্রতিনিধিরা বছরের নানা সময়ে এখানকার মূল সড়কে সামিয়ানা টানিয়ে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এসব অনুষ্ঠানে বাজানো হয় উচ্চশব্দের আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম। তখন এখানে থাকাই দায় হয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই স্পটসহ চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রায় ৩০টি স্পটে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ শব্দদূষণ ঘটছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল এলাকাগুলোকে নীরব এলাকা ধরা হয়। এসব এলাকায় শব্দের মানমাত্রা হচ্ছে ৪৫ ডেসিবল। কিন্তু নগরীর এ ধরনের ১৫ স্পটে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি মাত্রায় শব্দদূষণ ঘটছে।
সর্বশেষ মার্চ মাসে সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী, পাহাড়তলী গার্লস হাইস্কুলের সামনে ৭৬.৫ ডেসিবল, জিইসি এলাকার ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ৭১.০ ডেসিবল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সামনে ৭৭.৫ ডেসিবল, আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম মা ও শিশু মেডিকেল কলেজের সামনে ৭৮.৫০ ডেসিবল, আন্দরকিল্লা জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে ৭৪.৫ ডেসিবল, লালখান বাজার মমতা ক্লিনিকের সামনে ৭৭.৫ ডেসিবল, একে খান আল-আমিন হসপিটালের সামনে ৭৫.০ ডেসিবল, পাঁচলাইশ সার্জিস্কোপ হসপিটালের সামনে ৭৭.০ ডেসিবল এবং পূর্ব নাসিরাবাদের সাদার্ন হসপিটালের সামনে মার্চ মাসে ৬৮.৫ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা পাওয়া যায়।
অন্যদিকে আবাসিক এলাকায় শব্দের মানমাত্রা ৫০ ডেসিবল হলেও চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় ৬৭.৫০ ডেসিবল, মেহেদীবাগের আমিরবাগ আবাসিকে ৭৪.৫০ ডেসিবল, বাকলিয়া কল্পলোক আবাসিকে ৭৯.৫০ ডেসিবল মাত্রায় শব্দের তীব্রতা নির্ণয় করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
উল্লেখিত এসব এলাকাসহ পুরো শহরেই শব্দের তীব্রতা প্রায় একই রকম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী, মানুষের শব্দ গ্রহণের সহনীয় মাত্রা ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল। অথচ সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, চট্টগামের নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষিত এলাকায়ও শব্দের মাত্রা এর চেয়ে অনেক বেশি। নীরব এলাকায়ও প্রচুর শব্দদূষণ হচ্ছে। এখন নগরজীবনে স্বাস্থ্যঝুঁকির একটি অন্যতম কারণ শব্দদূষণ।
শব্দদূষণ নিয়ে গবেষণা করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা এবং স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬০টি স্পটে আমরা শব্দের মান পরিমাপ করি। আমাদের দেশের শব্দের যে মানমাত্রা, যেখানে ৪৫ থেকে ৬০ ডেসিবল মানের শব্দ থাকার কথা সেখানে আমরা ৮৫ থেকে ৯০ ডেসিবল শব্দের দূষণ পেয়েছি। চট্টগ্রামের শব্দদূষণের প্রধান উৎস তিনটি। যানবাহনের হর্নের শব্দ, নির্মাণকাজের বিভিন্ন যন্ত্রের শব্দ এবং রাজনৈতিক-সামাজিক অনুষ্ঠানের শব্দদূষণ। তবে যানবাহনের হর্নের শব্দ সবচেয়ে বেশি।
এলাকা হিসেবে চট্টগ্রামের অলংকার মোড়ে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ পাওয়া গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, শব্দদূষণের মূল উৎসগুলো বন্ধ করা গেলে শব্দের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হাইড্রোলিক হর্ন দেশে আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও চোরাইপথে বিদেশ থেকে আমদানি হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়েও এ ধরনের হর্ন তৈরি হচ্ছে।
এ গবেষক বলেন, শব্দদূষণ বন্ধে কঠোর আইন আছে। এই আইনের প্রয়োগ করা গেলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কেউ শব্দদূষণ করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন দিয়েও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। নগর ট্রাফিক পুলিশ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ আদালত শব্দদূষণের ক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাক-কান-গলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুরুল করিম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে যেভাবে শব্দদূষণ ঘটছে তাতে প্রত্যেক অবস্থায় ক্ষতিকর। মানুষ যদি দীর্ঘদিন ধরে মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে থাকে তাহলে তারা ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারাবে। কারণ শব্দের তীব্রতার কারণে মানুষের ধীরে ধীরে স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা ওষুধ দিয়ে নিরাময় সম্ভব হয় না। একসময় স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যায়। তখন মেশিন ছাড়া মানুষ কানে শোনে না। শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ক্ষুধামন্দা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, কাজে মনোযোগী হতে না পারা, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ, শোঁ শোঁ করাসহ উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম গবেষণাগার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. কামরুল হাসান বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর ধারাবাহিক কার্যক্রম নিয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রতি মাসে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্পটের শব্দের মান পরীক্ষা করা হয়। নগরীর শব্দদূষণের বড় অংশ হয় গাড়ি থেকে। পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বিশেষ করে বড় গাড়ির হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। হাইড্রোলিক হর্ন ধ্বংসের পাশাপাশি জরিমানাও করা হয়।