পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সবচেয়ে এগিয়ে বান্দরবান। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আড়ালে এ অঞ্চলে আনাগোনা বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর। যার কারণে পার্বত্য তিন জেলার মধ্যে অস্থিরতায়ও সবচেয়ে এগিয়ে এ জেলা।
বান্দরবানের এই অস্থিরতার সঙ্গে সম্প্রতি যে গোষ্ঠীর নাম সবার আগে আসছে সেটি হলো কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। বাংলাদেশের সরকার তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
কুকি-চিনের সন্ত্রাসীরা বান্দরবানে মেতে উঠেছে রক্তের খেলায়। অপহরণ, খুন, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে বান্দরবানের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে তারা।
সর্বশেষ গতকাল (মঙ্গলবার) বান্দরবানের রুমা উপজেলার জারুলছড়ি পাড়ার কাছে পানির ছড়ায় কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) বিস্ফোরণ ও অতর্কিত গুলিবর্ষণে দুই সেনা কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন দুই সৈনিক।
এই সন্ত্রাসীরা একদিকে যেমন সেনাবাহিনীর টহল টিমে হামলা করছে, আবার কখনও টাকার জন্য পাহাড়িদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন অনেক পাহাড়ি। প্রতিনিয়ত এসব চললেও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাচ্ছে না অনেকে।
এরআগে এপ্রিলে বান্দরবানে দু’পক্ষের গোলাগুলিতে আটজনের মৃত্যু হয়। এই সংঘর্ষেও কুকি-চিনের নাম আসে। কেএনএফ অবশ্য ‘ভা তে কুকি (Va Te Kuki)’ নামে একটি ফেসবুক আইডিতে নিহতদের এনআইডি কার্ড পোস্ট করে দাবি করে- তাদের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে।
বান্দরবানের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ে থমকে আছে উন্নয়ন কাজ। এছাড়া এদের কারণে পাহাড়ে বন্ধ রয়েছে পর্যটকদের আসা-যাওয়া। সব মিলিয়ে কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে থমকে আছে বান্দরবানের জনজীবন।
কুকি-চিনের অত্যাচারের কারণে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ পাহাড়ি তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে বান্দরবান সদর উপজেলার আশ্রয় শিবিরে উঠেছেন। কুকি-চিনরা বম সম্প্রদায়ের। কিন্তু নিজের সম্প্রদায়ের লোকদের ছাড়ছে না তারা।
কুকি-চিন শুধু নিজেরা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে তাই নয়, জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সদস্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে তারা।
তাই স্থানীয়রা বলছেন পাহাড়কে বাঁচাতে হলে কুকি-চিনের বিরুদ্ধে আরও শক্ত পদক্ষেপ দরকার সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে। তাদের এখন শক্ত হাতে দমন করতে হবে। তা না হলে পাহাড়ের অবস্থা আরও খারাপ হবে।
বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার রোয়াংছড়ি সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহ্লাঅং মারমা বলেন, কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ অনেক অশান্তিতে আছে। পাহাড়ের সাধারণ মানুষের সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই সন্ত্রাসীরা। কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি এবং মানুষজনকে জিম্মি করার কারণে পাহাড়ে কোনো ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম বর্তমানে করা যাচ্ছে না। কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের কারণে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে মানুষজন বসবাস করতে পারছে না। তারা পাহাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছে ও অপহরণ করছে, চাঁদা দাবি করছে। তাদের কথা যারা শুনছে না বা তাদের যারা চাঁদা দিচ্ছে না তাদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে। এর ফলে পাহাড়ি গ্রামের সাধারণ মানুষরা শহরের দিকে চলে যাচ্ছে। গ্রামগুলোর এমন অবস্থা যে কোনো গ্রামে যদি ৬০টি পরিবার থাকার কথা, সেখানে এখন আছে মাত্র ১০ থেকে ১৫টি বা সর্বোচ্চ ২০টি পরিবার। বাকি পরিবারগুলো জীবন বাঁচাতে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। সেনাবাহিনী পাহাড়ের সুখ-শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার ১নং পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উহ্লামং মার্মা বলেন, শান্তিপ্রিয় বান্দরবানে আর আগের মতো শান্তি নেই। এই কুকি-চিনের কারণে বান্দারবানে পাহাড়ি ও বাঙালি থেকে কোনো গোষ্ঠীই এখন আর ভালো নেই। কুকি-চিনের কারণে বান্দরবানে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হচ্ছে। তাদের ভয়ে পাহাড়ে রাস্তা ঘাটের পর্যন্ত উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। কুকি-চিনের সদস্যরা বান্দরবানের তথা পাহাড়ে নিয়মিত সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মানুষজনকে অপহরণ করছে, চাঁদা দাবি করছে। কেউ চাঁদা না দিলে প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে এই সন্ত্রাসী সংগঠনটি।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও ছাড়ছে না কুকি-চিন
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম এখন এমনভাবে বেড়েছে যে স্থানীয় লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বড় থেকে ছোট কোনো ব্যবসায়ীকে তারা বাদ দিচ্ছে না। চাঁদা না দিলে ব্যবসায়ীদের অপহরণ ও প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে সন্ত্রাসী সংগঠনটি। এ বিষয়ে বান্দরবান জেলার সমাজসেবক ও মানবাধিকার কর্মী উচিংমং মারমা বলেন, আমার জানা মতে কুকি-চিনকে পাহাড়ে কেউই সমর্থন করে না। এই সংগঠনের কারণে আমরা বান্দরবানবাসী এখন বিপদে আছি।
তিনি আরও বলেন, পাহাড়ি গ্রামের মানুষ তাদের জন্য অনেক সমস্যায় পড়েছে। গ্রামের লোকজনের কাছে গিয়ে তারা চাঁদাবাজি করছে। চাঁদাবাজি করে তারা সব কিছু চালায়। এখানে যারা কাঠ ও বাঁশের ব্যবসা করেন তারা মোটামুটি বড় ব্যবসায়ী। আর যারা বিভিন্ন রকমের ফল ও শাক-সবজি বিক্রি করেন তারা হলেন ছোট ব্যবসায়ী। এই কুকি-চিন কাউকেই বাদ দিচ্ছে না। সবার কাছ থেকে চাঁদাবাজি করছে। এই ছোট ব্যবসায়ীদের পুঁজিই বা কত! তবে ভয়ে কেউ কথা বলে না।
কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। কুকি-চিনের ভয়ে পালিয়ে আসা পাহাড়ি বাসিন্দাদের খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে সেনাবাহিনী। বর্তমানে কুকি-চিনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে। অন্যদিকে মাঝে মধ্যে জেএসএস, ইউপিডিএফসহ পার্বত্য অঞ্চলের আরও কয়েকটি সংগঠন পাহাড়কে অশান্ত করার চক্রান্তে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের দমনে পাহাড়ে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। পাহাড়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি আরও বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। পুলিশ কিংবা অন্য কোনো বাহিনীর পক্ষে এসব অপতৎপরতা বন্ধ করা সম্ভব নয় সেনাবাহিনীকে ছাড়া। পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য সেনাবাহিনীর আরও ক্যাম্প প্রয়োজন।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, কেএনএফ প্রধান নাথান বম ও এই সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা মিজোরাম ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করেন। দুর্গম পাহাড়ি এলাকার সুবিধা নিয়ে দ্রুত নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেন তারা। এছাড়া নাথান বম বেশি সময় মিজোরামে থাকেন বলেও জানা গেছে। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত তারা কুকি-চিনের ১৭ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেন। সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি রেখেছে র্যাব।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব কিন্তু সবার আগে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করে এবং তাদের সঙ্গে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের সংশ্লিষ্টতা পায়। পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের অনেককে আমরা আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি। মূলত তখন থেকেই, যখন র্যাবের অভিযান চলমান তখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা রাষ্ট্র বিরোধী অপরাধ মূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এর পরিপ্রেক্ষিতে কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের অনেককে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। যেহেতু তাদের অবস্থান পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন এলাকায়, সেহেতু পাহাড়ের ওপরে বা সেখানে যাওয়া কিংবা অভিযান পরিচালনা করা অনেকটা দুরূহ। তবে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং কুকি-চিন সন্ত্রাসীদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা গেছে যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে তাদের বিভিন্নভাবে জিম্মি করা, টাকা দাবি করা, হামলা করাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম কুকি-চিন সন্ত্রাসীরা করছে। সার্বিকভাবে আমরা গোয়েন্দা সংস্থা এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে এই সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছি।
কেএনএফের লোগোতে প্রতিষ্ঠাকাল ২০০৮ লেখা থাকলেও ২০১৮ সালে সংগঠনটির সন্ত্রাসী কার্যক্রম সবার নজরে আসে। তবে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে সংগঠনটির সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ভয়াবহতা পাহাড়ে বাড়তে থাকে। এরপর থেকে সংগঠনটির ওপরে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার অভিযোগ আসে। সংগঠনটি পার্বত্য অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক আয়তনের অঞ্চল নিয়ে বেআইনি ও মনগড়া মানচিত্র তৈরি করেছে। তাদের এই কল্পিত মানচিত্রের তিন পাশে রয়েছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত।