ফটিকছড়ির পাইন্দং ডলু এলাকায় মুজিব শতবর্ষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে গৃহহীন ও ভূমিহীন ৬৫০ পরিবারের। পাইন্দং ইউনিয়নের ডলু মৌজার কাঞ্চননগর রাবার বাগান ঘেঁষে প্রতিষ্ঠিত এ আশ্রয়ন কেন্দ্রে বসবাস করছে প্রায় ৩ হাজারের বেশি মানুষ। গৃহহীন পরিবারগুলো গৃহ পেলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল বসবাসকারী পরিবারগুলোর সন্তানরা। তারা পড়ালেখা করতে প্রায় ৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো প্বার্শবর্তী গ্রামের অন্য কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সন্তানদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যতের চিন্তায় আশ্রয়ণের ঘর ছেড়েছে বেশ কয়েকটি পরিবার।
এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে পাইন্দং ডলু আশ্রয়ণ কেন্দ্রের প্রবেশ মুখে প্রতিষ্ঠা করা হলো 'ডলু মুজিববর্ষ আশ্রয়ণ স্বপ্নযাত্রা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের'। গত ১৫ জানুয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। যা ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইউএনও সায়েদুল আরেফিন, পরে ইউএনও মহিনুল হাসান এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ক্রমান্বয়ে ইউএনও সাব্বির রাহমান সানি, মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী অনন্য অবদান রাখেন। পাইন্দং ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সরওয়ার হোসেন স্বপন ও সাবেক মেম্বার সালাহউদ্দিন সরওয়ারের অক্লান্ত শ্রম, আর্থিক অনুদান ও পিআইও আবুল হোসেনের সহযোগিতায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সরেজমিনে স্কুলটি পরিদর্শন করে দেখা যায়, টিনশেডের স্কুল ভবনের ভেতরে-বাইরে, প্রবেশ মুখ, দেয়াল সবখানে রাঙিয়ে তোলা হয়েছে নানা রঙে। রঙ-তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জাতীয় ফলমূল, পশুপাখি, দেশ-প্রকৃতি, বাংলা-ইংরেজি বর্ণ, মিনা কার্টুন ও মনীষীদের ছবি। এছাড়া অভিভাবকদের মতামত ও অভিযোগ নেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে মতামত ও অভিযোগ বক্স। ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। স্কুলের সামনে রয়েছে প্রশস্ত খেলার মাঠ। এছাড়াও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় শিশু শ্রেণির পাঠদানের কক্ষটি সাজানো হয়েছে নানা ধরনের খেলনা আর শিক্ষা উপকরণে। শিক্ষার্থীদের শিল্পমনা করে গড়ে তুলতে, দেশ-প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে এবং স্কুলগামী করতে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। রঙের ছোঁয়ায় স্বপ্নের স্কুলের যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। শিক্ষার্থীরাও খুব উৎফুল্ল। তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী মো. তায়েব জানায়, 'আগে পায়ে হেঁটে কষ্ট করে দুরের স্কুলে যেতে হতো। এখন আশ্রয়ণের মুখে স্কুল হওয়ায় প্রতিদিন তারা আনন্দে স্কুল যেতে পারে।'
আশ্রয়ণের বাসিন্দা ছালমা বেগম বলেন, আশ্রয়নে স্কুল হওয়ায় আমরা অনেক খুশী। আমার তিন ছেলে-মেয়ে এ স্কুলে পড়ে। আশ্রয়ণে আগে স্কুল ছিল না বলে দুরের স্কুলে গিয়ে পড়তে হতো। এতে বাচ্চাদের পড়াশোনা করতে কষ্ট হয়ে যেতো। এখন প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারছে এবং আমাদেরও কষ্ট লাঘব হয়েছে।'
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সার্বিক সহযোগিতায় স্কুলটি যাত্রা শুরু হয়েছে। মুলত স্কুলটি ২০২২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ২০২৪ সালে এসে স্কুলটি চালু হয়েছে।
স্কুলের সহকারী শিক্ষক মোঃ মানিক হোসেন বলেন, 'আশ্রয়ণের অধিকার বঞ্চিত শিশুদের রাষ্ট্রের সু-নাগরিক হিসেবে গড়া তোলার লক্ষ্যে এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আশা করি এ আশ্রয়ণের শিশুরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে একদিন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিবে।'
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রেজাউল করিমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি বিনামূল্যে বই বিতরণের মধ্যে দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় 'ডলু মুজিববর্ষ আশ্রয়ণ স্বপ্নযাত্রা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। স্কুলে প্রথম বছরেই ভর্তি হয় ১৬৪ জন শিক্ষার্থী। তাদের পড়াতে স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত রয়েছেন ৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। আলাপকালে তিনি বলেন, 'প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সরকারি করণের প্রক্রিয়া চলছে। সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্কুলটিও অন্য সব স্কুলের মতো আলো ছড়াবে।'
এদিকে, পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সহপাঠ্যক্রমের জন্য বিদ্যালয় ভবনের সমানেই রয়েছে প্রশস্ত মাঠ। সেখানেই শিশুরা খেলছে। মাঠের সংস্কার ও ভরাটের প্রয়োজনীতা রয়েছে বলে উল্লেখ করে পাইন্দং ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম সরওয়ার হোসেন স্বপন বলেন, 'স্কুলটির অবকাঠামো উন্নয়নের সাথে শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করছি। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য মাঠ ভরাট ও বাউন্ডারি ওয়াল তিনি নিজ উদ্যোগে করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, 'ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ন প্রকল্প করেছেন। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ক্লিনিক আর শিক্ষার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। আগামীতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলও হবে।'
স্বপ্নযাত্রা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিতে ভবিষ্যতে যথাযথ পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়ে ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিষ্ট্র্যাট মোঃ মুজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, 'সকল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল ড্রেস, শিক্ষা উপকরণসহ বই,খাতা, কলম ও অন্যান্য উপকরণ দেয়া হয়েছে। আশা করছি এখান থেকে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করবে। এছাড়া ইতিমধ্যে স্কুলটি সরকারীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।'