ডিসেম্বর আসলেই মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম তদানিন্তন বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়নের কথা মনে পড়ে যায়।১৯৭১ সাল,সারাদেশে চলছে যুদ্ধের দামামা সর্বত্র।এর থেকে সাবেক গুমানমর্দনও (বর্তমানে ভাগ হয়ে তিনটি ইউনিয়ন নাঙ্গলমোড়া গুমানমর্দন ও ছিপাতলী) পিঁছিয়ে নেই।সংগ্রাম মুখর এক কষ্ঠ-কঠিন,তবে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন ময়দান।মুক্তি সেনানীদের অভয়ারণ্য বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম।সোনালি স্বপ্নে বুক ভরা আশায় দেশমাতৃকার আজাদী আন্দোলনে যখন যুব সমাজ থেকে প্রৌড়রাও যুদ্ধের প্রচারে প্রায় অগ্রসরমান-অগ্রযাত্রায় নিবেদিত প্রান উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাও।ঠিক তখন দেশের বোকার স্বর্গে বসবাসকারী অনগ্রসরমান কিছু ব্যাক্তি যখন পাকিস্তানের অখন্ডতার পক্ষে;স্বাধিনতার বিপক্ষে গিয়ে নেতিবাচক কর্মকান্ডে লিপ্ত ছিল এবং গঠন করেছিল শান্তিকমিটি, রাজাকার, আল বদর এবং আল শামস নামে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন সহযোগী বাহিনী।তাদেরই সিনিয়র এক ব্যক্তি ছিলেন জনাব আব্দুল হালিম মুন্সি,সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান।নতুন আত্নীয় হওয়ার সুবাদে তার ঘরে একটু দুরে,তবে সামনাসামনি বসি আমরা কয়েকজন।তিনি আমার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,এই ছেলেটি কে?আমি বললাম,আমি মরহুম আবুল কালামের ছেলে।তার(আব্দুল হালিম মুন্সি) কথা মতে,' ‚৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার কাছে আবুল কালাম এবং শেখ নুরুজ্জমান চেয়ারম্যান আসে।তার মধ্যে আবুল কালাম আমাকে বলছেন"বদ্দা অনে স্বাধিনতার বিরুদ্ধে যি-ই-ন গইত্যে লাইগ্গুন,ইআন আর নগরিবান এরকম আঁরারে একখান লিখিত কাগজ দ-ন ফরিবু।লেখা ইয়েন আঁরা পত্রিকাত দিওম"।আব্দুল হালিম মুন্সি বললেন,আঁয়ই তারারে জবাব দিলাম যে,‚এ রকম ক-ন কাগজ আঁয়ই তোয়ারারে নইদ্দ্যুম"।যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে আমার সম্মনিত পিতা জনাব আবুল কালাম এবং আমাদের কাছের আত্নীয় জনাব শেখ নুরুজ্জমা চেয়ারম্যান(থানা আওয়ামি লীগের সাবেক সেক্রেটারি)এছিল তাঁদের যুদ্ধের উত্তাল সময়ে এক ঐতিহাসিক মহতি ও সাহসি প্রতিবাদের বহ্যিপ্রকাশ।আজ আমার শ্রদ্ধেয় পিতার একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিত জনদরদী শিক্ষাগুরুর কথা বলবো।যিনি ছিলেন অত্রাঞ্চলের একজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মানবিক যোদ্ধা।৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেসব নির্বচিত চেয়ারম্যান ছিলেন তাদের মধ্যে উত্তর চট্টগ্রামের বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এডভোকেট এ এম য়্যাহয়্যা ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশের জোয়ারা গ্রামের চেয়ারম্যান মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব বদিউল আলমের নাম প্রসিদ্ধ।আমাদের ঐক্যবদ্ধ গুমানমর্দনের সর্বশেষ চেয়রাম্যানের দায়িত্ব পালন করেন মরহুম এ এম য়্যাহ্য়্যা এডভোকেট।এদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গ্রাম উন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনে তাঁর অবদান শিরোধার্য।তাঁর সমাজসেবার প্রাণকেন্দ্র ছিল নাংগলমোড়া ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে।অত্র এলাকার কৃতিপুরুষ ও চেয়ারম্যান মরহুম ইদ্রিস মিয়া চৌধুরীর পর মরহুম য়্যাহয়্যা চেয়ারম্যান দীর্ঘ প্রায় এক যুগ দায়িত্বপালন করেন।এসময় বৃহত্তর গুমানমর্দন এর রাস্তাঘাট, শিক্ষদীক্ষায় প্রভূত উন্নতি করে।লাঙল মোড়ার মরহুম আবু তাহের চেয়ারম্যান ও ছিপাতলীর মরহুম নুরুজ্জমান চেয়ারম্যান তাঁর কাউন্সিল এর তদানিন্তন মেম্বার। পরবর্তিতে ইউনিয়ন কাউন্সিল ভাগ হয়ে তিনটি ইউনয়ন পরিষদে বিভক্ত হলে তাঁরা নিজ নিজ এলাকার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।মরহুম এডভোকেট এ এম য়্যাহ্য়্যা ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রাণপুরুষ।তিনি ছিলেন এক মহত গুণের তথায় সুন্দর সমাজ বিনির্মানের অগ্রপথিকের প্রতিকৃত।যিনি ছিলেন সবসময় নীতিবান, সদালাপি,মিষ্টভাষী অমায়িক এক সুন্দর বধন ও মৃধু-মিষ্টান্ন কথনের মানুষ।বুক ভরা ছিল দৃঢ় চেতনা দৃপ্ত এক দুর্দান্ত সাহসের প্রতীক।শ্রুতি মধুরতার শিক্ষায় সীক্ত থাকতো প্রায় সময়।সর্বসাধারন মানুষ পেত শান্তির পরশ।বিপদে-আপদে থাকতো সবসময় গরিব-দুঃখি-মেহনতি মানুষের পার্শ্বে।বুকে ছিল মহান আল্লাহর ওপর দৃঢ়-দৃপ্ত সাহসে ভরা মজবুত ইমানের ছোঁয়া।সততার ছোঁয়া ছিল তাঁর ভিতর অভাবনীয় স্ফুরন।চট্রগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ কি মি উত্তর পূর্বে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত হালদা নদীর পশ্চিম পাড়স্হ সবুজ শ্যামলীমায় ভরা প্রকৃতির কোল ঘেঁষে সবুজেভরে থাকা সুন্দর মনোরম পরিবেশে গুমানমর্দন ইউনিয়নের নিরিবিলি এক নির্মল পরিবেশে;সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে এই দৃঢ়চেতা মানুষটির জন্ম হয় ১৯৩৫।সেই শুভ-সুন্দর মানুষটির নাম জনাব এডভোকেট আবু মুহাম্মদ য়্যাহয়্যা।যাঁর ছোঁয়ার পরশে অনেক মানুষ পেয়েছে শিক্ষার সুদীপ্ত আলো এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা।যাঁর ছায়ায় থেকে হয়েছে অনেকে উঁচু মানের প্রেরণার প্রদীপ।যে অনেক মানুষকে আদরে আগলে ধরে প্রিয়তার বন্ধনে করেছে মহিয়াণ।শত্রু হঠিয়ে দিয়ে প্রিয় মাতৃভুমিকে করেছে সবুজ শ্যামলিমার চাদরে।যোগ্য এক সাহসী বলিষ্ট নেতৃত্বের ভাব অবয়বেই সীক্ত ছিল তার হৃদয়।হৃদয় রাজ্য সাগরে যদি থাকে শিক্ষার উঁচু মান বিদ্ধমান;তাহলেই সম্ভব সেই ভালোবাসার বাতায়নের বাতাসের স্নিগ্ধ সুভাসে শত্রু-মিত্রের মেলবন্ধনের সুন্দর হাসির স্নিগ্ধ স্ফুরন।এক সময় জনাব য়্যাহয়্যা সাহেবের অসুস্হতার খবরে আমরা বন্ধু এনায়েত উল্লাহ,চাচাত ভাই এমরান এবং আমিসহ ৩জন তাঁর বাসায় যাই এবং তাঁর সাথে দেখা হয়।তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন তুমি কার ছেলে? আমি বললাম আমি নাংগলমোড়ার আবুল কালামের ছেলে।এমহৎ মানুষটি আমাকে বললেন,‚আমরা আবুল কালামকে পড়াইছি"।সুতরাং এ মহান মানুষটি আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতার একজন সুযোগ্য শিক্ষাগুরু।সেই মহান-মহৎ মানবের শিক্ষায় আমার সম্মানিত পিতা হয়েছেন অলংকৃত ও সমাজ সেবার কর্মগুনে হয়েছেন বেশ গুণান্বিত -প্রসংশিত এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের কিছু বলিষ্ট ভুমিকায় হয়েছেন মহিমান্বিত।জনাব য়্যাহয়্যা সাহেবের মতো মানব দেশপ্রেমি জনসম্প্রীক্ত মানুষটিকে যখন এলাকার মুরুব্বী শ্রেণীর লোকজন বা শিক্ষিত সমাজ মানবতার সেবা দিতে ১৯৬৪ সনে ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী হতে বলেন,তখন তিনিও জনসেবার মানসে মনস্হীর করেন।নমিনেশন প্রদান করেন।এ রকম সাহসি পুরুষের নির্বাচনী নমিনেশন আগে এবং পরে সাহস যুগিয়েছেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও সুযোগ্য বড়চাচা জনাব আবুল কাশেম ছিদ্দিকী সাহেব।(যিনি থানা আওয়ামি লীগের সহসভাপতি)এবং এডভোকেট নুরুল আমিন সাহেবের পিতা আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম ইলিয়াছ সওদাগর। সেই প্রচ্ছন্ন বিবেকের মানুষটি এলাকার কাউন্সিলর ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রায় একযুগ প্রতিনিধিত্ব করেন।মহৎ মানুষের সৎগুণঃ-আমার পাড়াপড়সি এক কাছের বন্ধু মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান চট্রগ্রাম বন্দরের কর্মরত।তার বাড়ীর যায়গা সংক্রান্ত বিষয়ে এক জটলায় পড়ে।বন্ধু আব্দুল মান্নান আমার কাছে আসে;সমস্যাটা কিভাবে সমাধান করা যায়,এ বিষয়ে কথা বলতে।আমি বললাম এডভোকেট য়্যাহ্য়্যা চেয়ারম্যানের পুত্র এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান ভাইয়ের সাথে আলাপ করলে মনে হয় ভালো হবে।বন্ধু তার শ্বশুর আবুল কাসেম মেম্বার,ছোট ভাই জয়নাল আবেদিন এবং তার বড় শ্যালকসহ আমরা ৪ জন এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান সাহেবের চেম্বারের যাই।চেম্বারের বসা ছিলেন সুদর্শ আইনবিদ মান্যবর এডভোকেট য়্যাহয়্যা সাহেব।জনাব য়্যাহয়্যা সাহেব জনাব,আবুল কাসেম মেম্বারের পরিচয় জিজ্ঞেস করলেন।পরিচয় হলো,কথা হলো বেশ চমৎকার পূর্ণভাবে। এরপর য়্যাহয়্যা সাহেব কোর্টে আসার বিষয় নিয়ে এবং সমস্যার সম্পূর্ণ কথা জেনে নিলেন।মাণ্যবর য়্যাহয়্যা সাহেব বললেন,"এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে গ্রাম্য বিজ্ঞজনদের বিচারের মাধ্যমে"।‚কোর্টে এসব ব্যাপারে মামলা করলে যুগের পর যুগ পেরিয়ে যাবে কিন্তু কোন সমাধান পাবেন না"।এযেন সময়ের সুন্দর-সদূত্তোর পেলাম আবুল কাসেম মেম্বারসহ এবং আমরা সবাই।যুগের পর যুগ সময় নষ্ট না করে সহজ পথ বাতলে দিলেন।এমনি এক মহৎ এবং পরিচ্ছন্ন জ্ঞানের অধিকারী জনাব এডভোকেট য়্যাহয়্যা সাহেব।একটি ঐতিহাসিক রায়ঃ-আমার এক নানা জাফর হামজার বাড়ি নিবাসি আবুল বাসার (সধ্য প্রয়াত)।চাচাত ভাইয়ের সাথে,তার জমি-জমা সংক্রান্ত বেশ বড় সমস্যায় পড়েছিলেন;জনাব য়্যাহয়্যা সাহেব চেয়ারম্যান থাকাকালিন সময়ে।বিচারের জন্য জনাব আব্দুস সবুর চেয়ারম্যান সাহেবসহ তৎকালীন অনেক গণ্যমান্য ব্যাক্তিবর্গের উপস্হিতিতে বৈঠক হয়।বৈঠকে বিচারকগণ কাগজ পত্র সব দেখে নেয়।সব নথিপত্র দেখে জনাব য়্যাহয়্যা চেয়ারম্যান দোষি ব্যাক্তিকে ডেকে বলে দেন যে, জ্বাল দলিল গুলো বানিয়ে এনে মানুষকে কেন কষ্ট দিচ্ছ?আসলে সৎ-শিক্ষিত-দক্ষ মানুষের বিচার সৎই হবে স্বাভাবিক।বিচারের রায়টি ঐতিহাসিক হয়ে থাকলো ইতিহাসের পাতায়।এভাবে কর্মগুনে মানুষ হয় মূল্যাবান এবং মহিয়াণ।মুক্তিযুদ্ধ উত্তর সময়েও জনাব য়্যাহয়্যা সাহেব চেয়ারম্যান।তিনি পরাজিত চেয়ারম্যান নয়, ইস্তফা প্রদানকারী নির্লোভ জনপ্রতিনিধি বা চেয়ারম্যান ছিলেন।এটা একটা নজীর পদ থেকে ইস্তফা দেন।মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানেরজন্যে এলাকর সংখ্যালঘুরা তাঁকে গণসংবর্ধনা দিয়ে দূটি স্বর্ণপদক এবং নগদ অর্থ পুরুষ্কার দেন।তিনি নগদ অর্থ স্কুলে দান করেন।তাঁর ছোট ভাই বীরমুক্তিযোদ্ধা এমরান, চাচাতো ভাই রফিক সহ পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।তাঁর বাড়ীতে ও গ্রামের ঘরে ঘরে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পুরো চট্টগ্রামের বিভিন্ন যায়গায় শক্র বাহিনীর ওপর অভিযান পরিচালনা করেন।বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোহাম্মদ আলী, বীরমুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট মোহাম্মদ মূসা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট আলহাজ্ব নুরুল আমিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী নুরুল ইসলাম,বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আনোয়ার,বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু মোহাম্মদ এমরান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক নাসির উদ্দিন, পংগু মুক্তিযোদ্ধা কবি নূর মোহাম্মদ রফিক,সাবেক ছাত্রনেতা আলহাজ্ব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সোলেমান চৌধুরী সহ বহু মুক্তিযোদ্ধার লেখনি ও জবানীতে মহান মুক্তিযুদ্ধে মরহুম এডভোকেট য়্যাহ্য়্যার বিশেষ অবদান কৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করেন।সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে তিনি আজাদী সম্পাদক প্রফেসর মোহাম্মদ খালেদ সাহেবের প্রস্তাবকারী ছিলেন।এজন্য প্রফেসর খালেদ এর প্রতিদ্বন্দ্বী মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর সমর্থকরা তাঁকে অপহরণের চেষ্টা চালায়, যাতে তাদের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করে।কিন্তু য়্যাহ্য়্যা এডভোকেট এর বুদ্ধিমত্তা ও সাহসীকতার কাছে তারা হারমানে ও নৌকার প্রার্থীর জয় হয়।যুদ্ধে নিজ এলাকায় রাজাকার নিয়োগ না করায় পাক সেনারা একবার উনাকে ধরে নিয়ে যায়।তিনি তাদের বলেন ওখানে রাজাকার দিলে শান্তি নষ্ট হবে।পাক সেনারা পরদিন সরেজমিন পরিদর্শন করতে চাইলে তিনি রাতারাতি গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে খাল থেকে কাদা তুলে ডিসি রোড কে কর্দমাক্ত করে দিলে পাকসেনারা আর সেখানে গিয়ে নর হত্যা চালাতে পারেনি।তিনি রাউজান, হাটহাজারি, ফটিকছড়ির মুক্তিযোদ্ধাদের নিউক্লিয়াসে পরিণত করেন গ্রামটিতে।মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা করেন।তিনি বিভিন্ন সরকারী, বেসরকারী সুত্র থেকে আগাম সংবাদ সংগ্রহ করে মুক্তিযদ্ধাদের জানিয়ে দিতেন এবং সে অনুযায়ী পাক সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলতো।এলাকার একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি এলাকার উন্নয়নে নানাবিধ প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং রাস্তা ঘাট কার্লবার্ট নিরমান, সেচ প্রকল্প, সোনালী শ প্রকল্প ইত্যাদি গ্রহন করেন।চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ডিগ্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জনকারী এই এডভোকেট মহোদয় একজন সফল আইন বিশারদ ও ছিলেন।তিনি বহু ব্যাংক বীমা কোম্পানি শিল্প প্রতিষ্ঠান, সেনাকল্যান সংস্থা, সিডিএ প্রভৃতির আইন উপদেষ্ঠা ছিলেন।তিনি বংগবন্ধু সরকারের প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমবাশ সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন।তিনি জাতীয় সমবায় এর মহাসচিব, সমবায় ব্যাংক ও কোওপারেটিভ জুটমিলের ডাইরেক্টর,চট্টগ্রাম জেলার অধিন থানা সমবায় সমিতি সমূহের চেয়ারম্যান ছিলেন। উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় এ মহানায়ককে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের গাড়ীতে করে তাঁকে ডিসি হিলে ধরে নিয়ে যায়।জনৈক বদিউল আলমের সহায়তা তিনি সেদিন প্রাণে রক্ষা পান।শুধু এজন্যে যে যুদ্ধের দামামা যখন তুঙ্গে তখনও এ এলাকায় একদিকে মুক্তিযুদ্ধারা শক্তভাবে সংগঠিত হচ্ছে ও সংখ্যালগুরা বেশ নিরাপদে আছে।বীরোচিত সংবর্ধনাঃ মুক্তিযুদ্ধের অভয়ারণ্যে খ্যাত বৃহত্তর গুমান মর্দন(বিশেষ করে জনাব য়্যাহয়্যা সাহেবের বাড়ীই ছিল মুক্তিবাহিনীর অন্যতম ঘাটি)যা বর্তমানে নাঙ্গলমোড়া,গুমানমর্দন ও ছিপাতলী ৩টি ইউনিয়নে বিভক্ত।যুদ্ধচলাকলীন সময়েও একজন এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে সাধারণ জনগণের প্রতি সু-তিক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল দৃশ্যমান।শুধু মুসলমানদের নয় হিন্দু বৌদ্ধদেরও তিনি সৎ মানসিকতা নিয়ে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্হা করেন।বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘুরাও এগ্রামে নিরাপদ আশ্রয় নেয়। তাঁর নেতৃত্বে এ গ্রামের মানুষ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধা ও সংখ্যালঘুদের সহায়তা করেন।স্মর্তব্য যে,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল এল বি ডিগ্রিধারী, হাইকোর্টের সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তিনি।যা তৎকালীন সময়ে উত্তর চট্টগ্রামে খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর।বৃহত্তর গুমান মর্দন ইউনিয়ন কাউন্সিল যখন তিন ঋাগে ভাগ হয়ে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে রুপ নেয় তখন তিনি আর এলাকার জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে আইন পেশার মাধ্যমে দীর্ঘ চল্লিশ বছরাধিককাল আইনপেশার মাধ্যমে মানবসেবায় মনোনিবেশ করেন।অন্যায়ের সাথে অপোষহীন মনোভাবের মানুষটির পেশাগত সাফল্য, সততা ও মানবপ্রেম নিয়ে গ্রামের মানু্ষ এখনও গর্ব করেন।একজন সৎ এবং ধার্মিক মানুষ জনাব য়্যাহয়্যা সাহেবের দৃঢমনোভাবের বিনিময়ে দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে অত্র এলাকার সংখ্যালগুরা প্রায় নিরাপদে ছিলেন।তাই সংখ্যালগু,হিন্দু-বৌদ্ধ পরিবারে শৃংখলিত সম্ভ্রান্ত ফ্যামেলির ব্যাক্তিবর্গরা দু'টি স্বর্ণের মেডেল দিয়ে তাঁকে অভিষিক্ত করেন।স্হান হলো ঐতিহাসিক নাঙ্গলমোড়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠ।যে ময়দানের পরিচিতি-স্মৃতি নিয়ে গর্ব করে প্রায় দেশ-বিদেশে অত্র এলাকার কিছু গুনি ব্যাক্তিবর্গ।বরং দুরদুরান্তের কিছু কৃতি ব্যাক্তিও এ মাঠের তথা অত্র এলাকার প্রসংশায় পঞ্চমূখ থাকেন।এবং অত্র এলাকার বেশ কিছু মান্য জনের ভুয়সী প্রসংশা করতে দ্বীধাবোধ করেননা।শুনেছিΎ৫২ এর ভাষা আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল প্রণিধানযোগ্য।তিনি ৫২ এর হরতালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল থেকে পিকেটিং করার সময় বিপনী বিতানের মোড়ে পুলিশ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় মিছিলকারীরা তাঁকে পুলিশ থেকে কেড়ে নিয়ে আসে।সমাজ এবং রাষ্ট্রের এ বরেণ্য ব্যাক্তিকে মহান মালিকের ডাকে না-ফেরার পথে পাড়ি দিতে হয় সেই ২০০৭ সালের ৬মে, মাত্র ৭২ বছর বয়সে।তাঁর মৃত দেহকে তাঁর-ই প্রিয় শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের সেই খেলার মাঠ নাঙ্গলমোড়া স্কুল ময়দানে আনা হয় ১ম জায়নাজার জন্যে।সেখানে তাঁর ঘনিস্টজন মরহুম আব্দুস সবুর চেয়ারম্যান,মরহুম কামাল চেয়ারম্যান প্রমূখসহ আরও অনেকে তাঁর জীবনের কর্মময়তা নিয়ে কিছু আলোচনা করেন।(তাঁদের কয়েকজন ছিল খেলার সাথী)পরে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী হজরত মোল্লা মিসকিন শাহ্ মাজার সংলগ্ন কবরস্হানেই স্বীয় স্ত্রী আলহাজ্ব জায়তুন আরা বেগমের পাশে চিরশায়িত করা হয়,এ ক্ষনজন্মা বীরকে।আমরা এ-মহান ব্যক্তিকে স্মরণ করছি,স্বশ্রদ্ধ চিত্তে।স্মরণ করছি তাঁর রেখে যাওয়া কর্ম প্রেরণাকে।মৃত্যুর পূর্বে তিনি" জায়তুন -য়্যাহয়্যা ট্রাস্ট" নামে একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠান করে যান।যাঁর মাধ্যমে নিরবে বিভিন্ন সাদাকার কাজ চালু রয়েছে।তিনি কোরান হাদীসের দোয়া নামে একটি দোয়ার সংকলন রচনা করেন।তাঁর একপুত্র এক কণ্যা আইনবিদ, দূই কণ্যা চিকিৎসক।যেটুকু মরহুম এডভোকেট আলহাজ্ব আবু মোহাম্মদ য়্যাহ্য়্যার সততা ও নিষ্টা,সুন্দর-সুখময় প্রেরণায় আমাদের রেখে গেছেন তার নেক আমল কবুল করে প্রভু কর তুমি, তাকে জান্নাতের-ই শ্রেষ্টতম মেহমান।
লেখকঃ মানবাধিকার কর্মী ও ইতিহাস গবেষক। (নাঙ্গলমোড়া,হাটহাজারী )