আজ শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী : মেধা-মনন ও সততার প্রতিক

মো. এনামুল হক লিটন ও সাহেনা আক্তার | প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার ৩০ নভেম্বর ২০২১ ০১:০৯:০০ অপরাহ্ন | মতামত

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র চট্টলবীর আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী আমৃত্যু মানব কল্যাণে কাজ করে একজন গণমানুষের নেতা হিসেবে সকলের মণিকুঠায় ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। অদম্য এই রাজনীতিবীদ কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি। ২০০৫ সালের চসিক মেয়র নির্বাচনে তিনি তৎকালিন ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন মন্ত্রীকে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কয়েক দফায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের নগর পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত ৩:৩০ মিনিটে ৭৩ বছর বয়সে তিনি হৃদরোগ, কিডনি জটিলতাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যান। মেধা-মনন, সততার প্রতিক, ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান এই নেতার আজ বড়ই প্রয়োজন।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ক্ষমতা মোহের উর্ধ্বে যিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা। ছাত্র রাজনীতি দিয়ে শুরু করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর  রাজনীতি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী, সৃষ্টিধর্মী ও সেবাধর্মী। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি মেয়র থাকার সময় এ শহরে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন, অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন। এছাড়া জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ব্যাপক কাজ করার পাশাপাশী তিনি শ্রমিক আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

বর্ষীয়ান এ নেতা চট্টগ্রামকে এতটাই ভালোবাসতেন যে ১৯৯৮ সালে জাপান গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য তিনি কী-কী করেছেন। চট্টগ্রামের স্বার্থে বন্দর ও এয়ারপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করতেও দ্বিধা করেননি তিনি। মেয়র থাকাকালীন চট্টগ্রামের কোনো প্রকল্প নিয়ে একনেকে তদবির করতে যাননি। তিনি নিজের উদ্যোগে উন্নয়ন কাজ করতেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়ও মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের মেয়র হয়েছিলেন বীর চট্টলার গণমানুষের নেতা ছিলেন বলে। তিনি মেয়র থাকার সময় দোকানের ছোট-ছোট সাইনবোডের জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষে কোনো ট্যাক্স নিতেন না। গরীব রিকশা চালকের রিকশার লাইসেন্স নবায়নের জন্য কোনো টাকা নিতেন না। এভাবেই তিনি সেবাধর্মী রাজনীতি করেছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে টানা তিনবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। জনপ্রিয় এই সাবেক মেয়রের বাড়ি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ষোলো শহরের চশমা হিলে।

তাঁর বাসার গলিটি চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘মেয়র গলি’ হিসেবে পরিচিত। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পাকিস্তান আমলে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত থাকায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দেশ শত্রæ মুক্ত করার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের পর দলের অস্তিত্ব ধরে রাখায় বার-বার শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েছিলেন। তারপরও থেমে থাকেন নি। কখনো ছাড়েননি রাজনীতির হাল। বারবার জেল-জুলুম, আঘাত পেয়েও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বর্ষীয়ান এই নেতা রাজনীতিতে বহুমাত্রিক প্রতিভার কারিশমা দেখিয়েছেন এবং শিখিয়েছেন। এভাবেই তিনি দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় রাজনীতিবীদ হয়ে উঠেছিলেন। পেয়েছিলেন ‘চট্টলবীর’-এর উপাধি। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গহিরার শান্তিরদ্বীপ গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে পহেলা ডিসেম্বর ১৯৪৪ সালে এবি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম হোসেন আহমদ চৌধুরী ও মাতা বেদুরা বেগম। বাবা ছিল একজন চাকরিজীবী। তাঁর দাদার নাম আশরাফ আলী চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। নানা দলিলুর রহমান ছিলেন পোস্ট মাস্টার। তাঁর পূর্বপুরুষ তৎকালীন বার্মার আকিয়াবে বানিজ্য করতো। ইস্টার্ন রেলওয়েতে পিতা হোসেন আহমদ চৌধুরীর চাকরির সুবাদে প্রাইমারি থেকে এসএসসি পর্যন্ত তাঁকে বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বদলাতে হয়েছে। পিতা হোসেন আহমদ চৌধুরী দীর্ঘদিন রেলওয়েতে চাকরি করে সর্বশেষ স্টেশন মাস্টার পদে থেকে অবসর গ্রহন করেন।

পিতার ইচ্ছায় তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল সীতাকুন্ডের মনিন্দ্রনাথ প্রাইমারি স্কুলে। ঐ স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় ক্লাশে ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হয়ে তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন সীতাকুন্ড হাই স্কুলে। ঐ স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পিতার বদলির সুবাদে তাঁকে আবার চলে যেতে হয় নোয়াখালী জিলা হাই স্কুলে। এরপর আবার পটিয়া রাহাত আলী হাইস্কুল, চট্টগ্রামের প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ, কাজেম আলী হাইস্কুল এবং সর্বশেষ হাটহাজারী খন্দকিয়া শিকারপুর হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৬২ সালে মেট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাবস্থায় পিতার ইচ্ছায় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিউটে ভর্তি হন। প্রায় দুই বছর তিনি পলিটেকনিকে পড়াশুনা করেন। ছাত্র আন্দোলনে নের্তৃত্ব দিতে গিয়ে ওই কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর পুনরায় ভর্তি হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজে। ১৯৬৫ সালে উক্ত কলেজ থেকে এইচ এস সি পাস করেন। ১৯৬৭ সালে ডিগ্রি লাভ করে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগের মনোনয়ন পেয়ে চাকসু নির্বাচনে ভি পি প্রার্থী হয়েছিলেন।

কিন্তু জয়লাভে ব্যর্থ হন তিনি। এরপর কিছুদিন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার পর তিনি বিশ^বিদ্যালয় ত্যাগ করে আইন শাস্ত্রে পড়াশুনা শুরু করলেন। কিন্তু পরীক্ষায় গঠন টোকাটুকির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তাঁর আইন বিষয়ে পড়াশুনা আর হলো না। ছাত্র জীবনে তিনি কাব, স্কাউট, সি স্কাউট ও রোভার স্কাউট ছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তান চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক তখন তার নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে। তখন সভাপতি ছিলেন মৌলভী সৈয়দ আহমদ। তাদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ, সিটি কলেজ, কর্মাস কলেজ, মেডিকেল কলেজ, আইন কলেজ, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিউট ও এমই এস কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ সাফল্য অর্জন করে। তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকার স্কুল-কলেজ এবং ওয়ার্ডে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করে শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে দাঁড় করাতে কঠোর পরিশ্রম করেন।

ষাটের দশকে ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে তাঁর ছিল সাহসী নেতৃত্ব। তিনি ছিলেন, সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা। হরতালের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন বালুচড়া থেকে গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন। এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী ছিলেন একজন পরিশ্রমী ছাত্রনেতা যার ফলশ্রুতিতে তাঁর একাগ্রতা ও সাধনার বলে তিনি অল্পসময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম ছাত্রলীগের প্রথম কাতারের ছাত্রনেতা ও আন্দোলন সংগ্রামের দিক নির্দেশক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ১৯৬৬-৬৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজকে ছাত্রলীগের দূর্গ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার যথেষ্ট অবদান রয়েছে।

তৎকালীন পাকিস্তানী শাসন-শোষণের বিরুদ্বে যখনই কোন হরতাল ডাকা হতো তার আগের দিন মিছিল, মশাল মিছিল, পিকেটিং ও খন্ড-খন্ড পথসভা করে চট্টগ্রামের রাজপথ প্রকম্পিত করতেন বীর চট্টলার বীর মহিউদ্দিন চৌধুরী ও অন্যান্য ছাত্রলীগ নেতারা। হরতালের আগের দিন গভীর রাতে তাঁরা রাস্তায় ব্যারিকেট তৈরী করতেন। এভাবে ধীরে-ধীরে ছয় দফার আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন বেগবান হয়।

১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের কমিটিকে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ আর এক বছর বর্ধিত করার সিদ্বান্ত গ্রহন করে। ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করেল মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘সামরিক আইন’ বিরোধী মিছিল বের করা হয়। পরিকল্পনা করে সামরিক আইন ভাঙ্গা হয়। মুসলিমলীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দৈনিক আজান পত্রিকার অফিস জ¦ালিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের শাসন বিরোধী বক্তৃতা, সাময়িক আইন ভঙ্গ করে সভা এবং মিছিল, মুসলিম লীগের মুখপত্র দৈনিক আজান পত্রিকায় হামলা ও জ¦ালিয়ে দেওয়ার অভিযোগে দায়েকৃত মামলায় সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত শহর ছাত্রলীগ নেতা মোহাম্মদ ইউনুসের নয় মাস সশ্রম কারাদন্ড হয়। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ ঘোষণা করেন। এই ঘোষনার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের ছাত্রজনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদে চট্টগ্রাম কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ শুরু হয়। মহিউদ্দিন  চৌধুরীসহ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পরদিন হরতাল ও ঐতিহাসিক লালদিঘির মাঠে জনসভার ডাক দিলেন। ২রা মার্চ ঐতিহাসিক লালদিঘির ময়দানে মহিউদ্দিন চৌধুরী ও অন্যান্য ছাত্র নেতাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে খবর এলো ঢাকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের নতুন পতাকা বানানো হয়েছে। সাথে-সাথে মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরীর রিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে কাপড় কিনে এনে বাংলাদেশের অনুরূপ পতাকা তৈরি করেন। এসব পতাকা নিয়ে ছাত্র-জনতার মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। সিটি কলেজে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করার জন্য মৌলভী সৈয়দ আহমদকে প্রধান ও মহিউদ্দিন চৌধুরীকে উপ-প্রধান করে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়।

গোপনে সিটি কলেজে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঝাঁউতলার পাহাড়তলী ওয়ারলেস্ কলোনীতে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা শুরু হয়। এসময় পাকিস্তানী নৌবাহিনীর গুলিতে প্রথম শহীদ হন ভিক্টোরিয়া জুট মিলের শ্রমিক আবুল কালাম। টাইগারপাস থেকে বিশাল মিছিল মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে লালদীঘি ময়দানে পৌঁছে। ঐ সমাবেশে তিনি অবাঙালিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া একটি অস্ত্র প্রর্দশন করলে, জনতা খুবই উত্তেজিত হয়ে অবাঙালিদের আক্রমন করার জন্য এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে চট্টগ্রাামের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের একটি দল ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় যোগদান করেন। তখন ছাত্র জনতার গগন বিদায়ী শ্লোগানে বাংলাদেশ প্রকম্পিত হয়ে উঠল। জনতার শ্লোগান ছিল মুজিব তুমি ঘোষণা কর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, বীর বাঙালি অস্ত্রধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর। তুমি কে? আমি কে? বাঙালি-বাঙালি, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা, রক্ত সূর্য উঠেছে  বীর বাঙালী জেগেছে। জয় বাংলা। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পাওয়ার পর চট্টগ্রাম ফিরে মহিউদ্দীন চৌধুরী ও অন্যান্য ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ কর্মীরা রাইফেল ক্লাব ও মাদার বাড়ি এলাকার অস্ত্র গুদাম থেকে বিপুল  পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নেয়। শুরু হয় জনযুদ্ধের প্রস্তুতি। লালদীঘি ময়দানে জয় বাংলা কুচকাওয়াজ হলো। প্রস্তুতি শুরু হলো সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের। উত্তাল পরিস্তিতিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সদস্য, তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ বাহিনীদের সংগঠিত হতে ছাত্রলীগের কর্মীরা মাইকিং করে প্রচার করতে থাকে এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত কন্ট্রোলরুমে যোগাযোগের আহবান জানানো হয়। এই ঘোষণার পর এসব বাহিনীরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে। এরা সকলে আন্দরকিল্লা ও স্টেশন রোডস্থ রেস্ট হাউজের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এসে যোগাযোগ করতে লাগল। আর ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতারা এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সকালে বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণাটি জহুর আহমদ চৌধুরীর দামপাড়াস্থ বাসায় পাঠানো হয়।

তাঁর স্ত্রী ডা. নুরুন্নাহার জহুর বার্তাটি গ্রহণ করেন। ওই সময়ে জহুর আহমদ চৌধুরী বাসায় ছিলেন না। খবর পেয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী দ্রুত তাঁর বাসায় গেলেন। বার্তাটি তিনি নুর আহম্মদ সড়কের গেস্টেট নার নামের একটি পাইভেট প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বেশ কিছু কপি সাইক্লোস্টাইন করে বিলির ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ ইউনুছ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সুবেদার সিদ্দিকুর রহমানসহ অন্যান্যরা রেস্ট হাউজ থেকে খাবার-দাবার নিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ক্যাম্পের দিকে রওনা হন। তাদের হাতে ছিল রাইফেল, তাদের বহনকারী জিপ গাড়িটি জুবিলী রোডের নেভাল অ্যাভিনিউর মোড়ে গেলে পাকিস্তানী নৌ-কমান্ডো দ্বারা আক্রান্ত হন। ওই সংঘর্ষের পর মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ সকলে গ্রেপ্তার হন। তাদেরকে আমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে মহিউদ্দিন চৌধুরীর কলারবোন ভেঙ্গে যায়। এক পর্যায়ে তাদেরকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগার থেকে তাদেরকে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে শ্রমিকের কাজে লাগানো হতো। তৎকালিন চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার ছিলেন, বাঙালি অফিসার খালেক। পাকিস্তান বাহিনীর স্টেশন কমান্ডার ছিলেন, এক বেলুচ ক্যাপ্টেন। তিনি জেল পরিদর্শনে এসে জেলারের সাথে পরামর্শ করে পাগল জাতীয় বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেন। এ খবর গোপনে পৌঁছে দেওয়া হলো, মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ তার সাথীদের। তখন তাঁর ইশারায় সকলে পাগলের অভিনয় করতে থাকলেন। একপর্যায়ে তাঁদেরকে পাগল ভেবে ছেড়েও দেয়া হলো। মুক্তি পেল মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ ত্রিশজন। মুক্তিলাভের কয়েকদিন পর তিনি ভারতে চলে যান গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য। এসময় তিনিসহ তাঁর দল আগরতলায় শ্রীধর ভিলায় চলে যান।

সেখান থেকে একদিন শেখ ফজলুল হক মনি কোলকাতায় নিয়ে যান মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। সহযোদ্ধাদের পাঠানো হয় উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। টান্ডুয়া সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের ১৩তম স্কোয়াড কমান্ডার নিযুক্ত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর ভারতে উচ্চতর গেরিলা লির্ডাস প্রশিক্ষণে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে পূর্বাঞ্চলীয় মাউন্ট ব্যাটালিয়নের প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে পাকবাহিনীর এবং তাদের দোসর মিজু বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। এই লড়াই ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আঠার ডিসেম্বর তিনি তাঁর দলবল নিয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। এরপর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুর্ণগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহিত হলে, তিনি হত্যার প্রতিবাদে প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে যান। পরে জামিন লাভ করে অসীম সাহসী কয়েকজন সহযোদ্ধাদের নিয়ে আন্ডারপ্রাউন্ডে চলে যান। এসময় মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্বে চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। এ অবস্থায় গ্রেফতার এড়াতে তিনি ভারতে চলে যান। রাজনৈতিক কারণে ফেরার জীবনের তাগিদে তাকে ভারতের কোলকাতায় চায়ের দোকানে চাকরি নিতে হয় এবং এর পাশাপাশি বাড়তি রোজগারের জন্য হাওয়া রেলস্টেশনে হকারের কাজ করতে হয়। ভারতে তাঁর ফেরার জীবন কাটে দুই বছর। ভারত থেকে দেশে ফিরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে রাউজানে সংসদ নির্বাচন করেন। কিন্তু বিজয় ছিনিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। ১৯৯১ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী আসন থেকে দ্বিতীয় দফায় সংসদ নির্বাচন করেন।

এবারও তিনি জয়লাভ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি। চট্টগ্রাম শহরে আওয়ামী লীগ সংগঠনকে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে সু-সংগঠিত করতে লাগলো। শুধু সংগঠন নয়, নগরীর প্রতিটি এলাকার সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করার জন্য তিনি তাদের বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্যার সমাধানের জন্য তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। এছাড়াও চট্টগ্রামের বিভিন্ন মিল কারখানায় শ্রমিক লীগকে সংগঠিত করে তিনি নেতৃত্ব দিতে লাগলেন। ধীরে-ধীরে তিনি চট্টগ্রামের একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাতে পরিণত হলেন।

যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালের মেয়র নির্বাচনে চট্টগ্রামবাসী তাঁকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করে সিটি মেয়র নির্বাচিত করলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হলেন। ১৯৯৪ সালের ১১ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর মেয়র হিসেবে সাফল্য অর্জনের পর ২০০০ সালের পহেলা মার্চ বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় দ্বিতীয় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে তিনি তৃতীয় দফায় চট্টগ্রামবাসীর ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মেয়র থাকাকালীন এক-এগার সরকার ক্ষমতা এসে ২০০৭ সালের ৭ই মার্চ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০০৮ সালে মুক্তিলাভ করেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী ছাত্রলীগের রাজনীতির ইতি টেনে যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন। তিনি যুবলীগ নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রিয় প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম শ্রমিক রাজনীতিরও প্রাণপুরুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ২০০৬ সালে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহন করেন। মৃত্যুর আগমূর্হুত্ব পর্যন্ত তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

দীর্ঘ রাজনীতির জীবনে তিনি ছিলেন মাঠের মানুষ। জননেতা এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমএ মান্নানসহ অনেক ত্যাগি ও দূরদর্শী নেতাদের সান্নিধ্য পেয়ে তিনি জয়ী হয়েছেন নিজ রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলে। তাঁর সততা, একাগ্রতা, কঠোর মনোবল, পরিশ্রম, স্বপ্ন-সাধনা ও মানুষের প্রতি অকৃতিম ভালোবাসা, আর্দশের প্রতি গভীর আস্থা ও নেতৃত্বের প্রতি অগাধ বিশ্বাসই তাকে একজন রাজনৈতিক নেতা ও কিংবদন্তী পুরুষে পরিণত করেছিল। তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন জনদরদী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর প্রথম স্ত্রী শাহেদা মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন ও দুই ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে তাঁর পরিবার। তাঁর বড় মেয়ে টুম্পা মারা গেছেন। চট্টগ্রামের উন্নয়ণে ও জনস্বার্থে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর যে অবদান তা চট্টগ্রামবাসীর মাঝে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রামের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। যা কখনো পোষাবার নয়। জন্মদিনের এই দিনে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বীর চট্টলার বীর মহিউদ্দিনকে। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নসিব দান করুন। আমিন।    
লেখকদ্বয় : মো. এনামুল হক লিটন/সাহেনা আক্তার, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল সংবাদপত্র পাঠক লেখক ফোরাম, কেন্দ্রিয় কমিটি।