আজ শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

করোনাকালে সিএমপি’র ভালো-মন্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ১২:০৯:০০ অপরাহ্ন | চট্টমেট্টো

দরজায় কড়া নাড়ছে ২০২২ সাল। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষী ২০২১ সাল। বিদায়ী বছরে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) প্রত্যেকটি থানা।

মাদক ব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলার আসামিদের গ্রেফতারসহ বছরজুড়ে ব্যস্ত ছিল পুলিশ সদস্যরা। বছরজুড়ে এই অঙ্গনে আলোচিত ছিল- রোগীর জন্য পুলিশের ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি অটোরিকশা সেবা চালু, হাজার হাজার গরিব ও দুস্থকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, সিএমপির প্রত্যেক থানায় অক্সিজেন ব্যাংক, সিএমপি-বিদ্যানন্দের এক টাকায় ঈদ আনন্দ, রাতে নিরাপত্তা প্রহরীদের জন্য পুলিশের বিশেষ ‘ক্লাস’, সিএমপিতে নতুন প্রযুক্তি, পুলিশের শরীরে ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’, সিএমপিতে ডোপ টেস্ট, গাড়ি চাপা দিয়ে পুলিশ হত্যা, বন্দরনগরী সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা, চাঁদাবাজির অভিযোগে কারাগারে ৬ পুলিশ সদস্য ও পুলিশ হেফাজত থেকে আসামি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা।  

রোগীর পাশে পুলিশ 

সরকারি বিধিনিষেধ চলাকালীন গত ২৯ জুলাই জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছিল সিএমপির ডবলমুরিং মডেল থানা। রোগীদের জন্য ব্যবস্থা করেছিল অ্যাম্বুল্যান্স ও সিএনজি অটোরিকশা সেবা। রোগীরা এসব গাড়িতে বিনামূল্যে হাসপাতালে যেতে পেরেছেন। এই থানায় ৭ আগস্ট প্রতীকী একটি গাছ বসিয়ে তাতে থরে থরে ঝোলানো হয় মাস্ক। নাম দেওয়া হয় ‘মাস্ক ট্রি’। মানুষকে মাস্ক পরতে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যতিক্রমী এই প্রচারণা চালিয়েছিল পুলিশ। মানুষ বিনামূল্যেই এই গাছ থেকে নিয়েছে রঙ-বেরঙের সব মাস্ক। ছয়টি বিটের মোট ১০টি স্পটে এই গাছ স্থাপন করা হয়। গত ৭ আগস্ট করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ও জনসচেতনতা প্রতিরোধে পথচারীদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।

খাদ্যসামগ্রী বিতরণ

সিএমপির প্রত্যেক থানা থেকে করোনা পরিস্থিতিতে গরিব ও দুস্থ হাজারও মানুষকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। গত ১৫ এপ্রিল বন্দর বিভাগের উদ্যোগে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। ২১ এপ্রিল রীমা কনভেনশন সেন্টারে সিএমপি দক্ষিণ বিভাগের ২৪টি বিট এলাকায় খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। ২৫ এপ্রিল সিএমপি পশ্চিম বিভাগের উদ্যোগে ১০ হাজার মানুষকে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। প্রতিটি পরিবারকে চাল, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ, আলু, লবণ, ভোজ্যতেল ও সাবানসহ সাড়ে ১২ কেজি খাদ্যদ্রব্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হয়। ২৪টি বিট এলাকায় ২ হাজার ৫০০ দরিদ্র পরিবারের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয় এসব সহায়তা।  

প্রাণ বাঁচাতে অক্সিজেন ব্যাংক

 সিএমপির পক্ষ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপ মোকাবিলায় প্রতিটি থানায় গড়ে তোলা হয় অক্সিজেন ব্যাংক। করোনার সময়ে অক্সিজেন-সংকটে ভুগতে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়াতে এ ব্যতিক্রমী ব্যাংক স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সিএমপি। এর ফলে প্রতিদিন বহু পরিবারের জরুরি মুহূর্তে অক্সিজেন সিলিন্ডারের দুশ্চিন্তা দূর করেছিল পুলিশ। অক্সিজেন ব্যাংক থেকে মানুষ সেবা পেয়েছিল।  

এক টাকায় ঈদ আনন্দ

সিএমপি ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে ১০ মে ঈদ-উল-ফিতরের সময় সমাজের ছিন্নমূল মানুষের ঈদ আনন্দ বাড়িয়ে দিতে ‘এক টাকায় ঈদ আনন্দ’ কার্যক্রম চালানো হয়। একটি কনভেনশন সেন্টারে বিভিন্ন বয়সী লোকজন জড়ো হয় এক টাকায় তাদের পছন্দের পণ্যটি কিনতে। শিশুরা যেমন বেছে নিয়েছিল পছন্দসই কাপড়, তেমনি বয়স্ক নারী-পুরুষও নিয়েছেন তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। বাজারের হাজার টাকার পণ্য তারা এক টাকায় কিনতে পেরে ছিলেন উচ্ছ্বসিত।  

নিরাপত্তা প্রহরীর জন্য বিশেষ ক্লাস

বাসা ও বাড়ির দারোয়ান, বিভিন্ন ব্যাংকের বুথের সিকিউরিটি গার্ড ও ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীদের জন্য ব্যতিক্রমী এক ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিল সিএমপির ডবলমুরিং থানা। ব্যতিক্রমী এই ক্লাসে বাসা, বাড়ি, মার্কেটের দারোয়ান, বিভিন্ন ব্যাংকের বুথের সিকিউরিটি গার্ড ও ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীদের তাদের দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঙ্কটকালীন মুহূর্তে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৪ আগস্ট রাতে নগরের ডবলমুরিং থানার ছয়টি স্থানে ক্লাসের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই কার্যক্রম।

শরীরে ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে (সিএমপি) প্রথমবারের মতো ২৪ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে মাঠ পর্যায়ে চালু হয়েছিল ‘বডি ওর্ন ক্যামেরা’ কার্যক্রম। দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তার শরীরে এই ক্যামেরা চালু করা হয়। এর আগে ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশ এই কার্যক্রম শুরু করলেও থানা পর্যায়ে দেশে প্রথমবারের মতো এই কার্যক্রম শুরু করেছিল সিএমপি। পাইলট প্রকল্পের আওতায় সিএমপির চার বিভাগের চার থানায় এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। চার থানাগুলো হলো- ডবলমুরিং, কোতোয়ালী, পাঁচলাইশ এবং পতেঙ্গা। প্রত্যেক থানাকে ৭টি করে ক্যামেরা প্রদান করা হয়েছিল।

বন্দরনগরী সিসি ক্যামেরার আওতায় 

২৫ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বলেছিলেন, নগরীকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) আওতায় আনতে ৭০০ স্পটে ক্যামেরা স্থাপনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে নগরের ৭০টি স্পটে ৪১১টি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। সিএমপির নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি কোনও কোনও স্থানে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। তবে সব ক্যামেরা সিএমপির নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মনিটরিংয়ের আওতায় থাকবে। ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে পুরো নগরকে একটি স্থান থেকে বসে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। সিএমপির সদর দফতরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু আছে। এজন্য একটি অফিসার প্যানেল করা হয়েছে। এসব ক্যামেরা সচলের বিষয়ে তারা দায়বদ্ধ থাকবে। নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ৩২৪টি ক্যামেরা দিন-রাত পর্দায় সচল থাকবে, যেগুলোর ফুটেজ ১৫দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে। এর আগে, ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রথম ২৫টি স্পটে ১১০টি ক্যামেরা স্থাপন করা হলেও পরবর্তী সময়ে সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে।

‘আমার গাড়ি নিরাপদ’

যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘আমার গাড়ি নিরাপদ’ কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। বিভিন্ন সময় যাত্রীরা তাদের অনেক মূল্যবান সামগ্রী সিএনজি অটোরিকশায় ফেলে আসেন। যাত্রীরা যদি নিউমেরিক আইডি অথবা কিউআর কোড স্ক্যান করে রাখেন পরবর্তীতে সহজেই সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সিএনজিচালিত অটোরিকশার মাধ্যমে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ সহজেই উদঘাটন ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একইসঙ্গে সিএনজি অটোরিকশা মালিক তার গাড়ি যেকোনও চালককে দেওয়ার আগেই সহজেই তার ভেরিফিকেশন কার্ড দেখে চালক সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবেন। একজন সিএনজিচালক ভেরিফাইড থাকলে যাত্রী এবং গাড়ির মালিকের কাছে চালক সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। নগরের ৮টি পয়েন্টে স্থাপিত বুথের মাধ্যমে সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক ও চালকের নিবন্ধন সম্পন্ন করার কাজ চলমান রয়েছে। নগরে চলাচলরত রেজিস্ট্রেশনকৃত প্রায় ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশাকে এ কার্যক্রমের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে সিএমপি।

ডোপ টেস্ট 

ডোপ টেস্টে পজিটিভ এবং মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ছয় সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। আরও ৫ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ডোপ টেস্টের বাইরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে আরও ২১ পুলিশ সদস্যকে। মোট ডোপ টেস্টে পজিটিভ ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় ২৭ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

গাড়ি চাপা দিয়ে পুলিশ হত্যা

নগরের চান্দগাঁও থানা এলাকায় দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় গত ১১ জুন ভোরে এএসআই কাজী মো. সালহউদ্দিনকে গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছিল, মাদক পরিবহনে ব্যবহার করা মাইক্রোবাস আটক করতে গিয়ে এ ঘটনা ঘটে। ওই গাড়ি থেকে সাড়ে ৭০০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়। মাদক পাচারের সময় সঙ্গে থাকা মোটরসাইকেলও জব্দ করা হয়েছিল। ১৮ জুন  সিসিটিভি ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রেফতার করা হয় চালক বেলাল, মাদক ব্যবসায়ী শামসুল আলম ও রাসেলকে।

চাঁদাবাজি ও হেফাজত থেকে পলায়ন 

গত ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে আনোয়ারার পূর্ব বৈরাগ গ্রাম থেকে আবদুল মান্নানকে তুলে নিয়ে যায় ৮ তরুণ। এসময় তারা নিজেদের পুলিশের লোক বলে পরিচয় দেয়। এমনকি একজনের গায়ে ডিবি লেখা জ্যাকেটও ছিল। পরে ওই তরুণরা আবদুল মান্নানকে পটিয়ার ভেল্লাপাড়া এলাকায় নিয়ে আটকে রাখে। এসময় আবদুল মান্নানের বিরুদ্ধে থানায় অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে জানিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে ওই ৮ তরুণ। পরবর্তীতে তাদের ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হলে তারা তাকে ছেড়ে দেয়। পরে পুলিশ সদস্য পরিচয়ে অপহরণ এবং মুক্তিপণের অভিযোগে গত ৭ ফেব্রুয়ারি আনোয়ারা থানায় মামলা দায়ের করেন আবদুল মান্নান। গ্রেফতার ছয় পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল।

আনোয়ারার বৈরাগ গ্রামের আবদুল মান্নান বাদী হয়ে ছয় পুলিশ সদস্যের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। এজাহারে সরকারি কর্মচারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে অপহরণ, টাকা দাবি ও হত্যার হুমকি দিয়ে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর আদালতে ছয় পুলিশের সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ করেছিল আদালত।  

১৬ নভেম্বর দুপুরে কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজার সামনে থেকে ১৪ হাজার পিস ইয়াবাসহ মুন্সী আজমীর হোসেন (৩৫) নামে বাকলিয়া থানার এক পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।  

গত ৫ ডিসেম্বর থানা থেকে আদালতে নেওয়ার সময় নগরের কোতোয়ালী থানা পুলিশের হেফাজত থেকে আবুল কালাম (২৫) নামে এক আসামি পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটি প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে কর্তব্যে অবহেলার দায়ে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টর ও দুই কনস্টেবলকে সাসপেন্ড করে। পালিয়ে যাওয়া আসামি আবুল কালামকে একইদিন দিবাগত রাতে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে গ্রেফতার করা হয়।

 

 

 

 

 

 



সবচেয়ে জনপ্রিয়