ভ্যানচালক নবীর হোসেন। ঘাটের মালামাল পরিবহন করে চলে তার সংসার। দীর্ঘদিন থেকে পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে জোড়াতালি দিয়ে তৈরি ঘরে বসবাস করে আসছেন। বাড়ির উঠানে থাকা কড়ই গাছটি কেটে সেই কাঠ দিয়ে ঘর মেরামত করবেন বলে অনেক দিনের আশা তার। ঝড়ে সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো নবীরের।
সোমবার রাতের ঝড়ে গাছটি নবীরের ঘরের ওপর পড়ে। তাতে পুরো ঘরটি একেবারে ভেঙে চুরমার। নোয়াখালী হাতিয়ার চরকিং কলেজপাড়া গ্রামের নলচিরা-ওচখালী প্রধান সড়কের পাশে নবীরের বাড়ি। সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হয় নবীরের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বাড়ির ভেতরে ডেকে নিয়ে যান তিনি। মিডিয়ায় প্রচার হলে কিছু পাবেন এমনটি আশা করেন নবীর।
আলাপকালে জানান, রাতে ঝড়ের মধ্যে বাজার থেকে আসেন ৯টার সময়। বাড়ির দরজায় আসার সঙ্গে সঙ্গে গাছটি ঘরের চালের ওপর পড়ে। এ সময় ঘরে তার তিন সন্তান ও স্ত্রী ছিল। পরে হাতে থাকা লাইট জালিয়ে স্ত্রী ও সন্তানদের খুঁজতে থাকেন। গাছের চাপে ঘরের চাল ভেঙে পড়ে তাতে আটকা পড়েন স্ত্রীসহ সন্তানরা। টেনে এক এক করে সবাইকে বের করেন তিনি। পরে অন্যের বাসায় বাকি রাতটুকু কাটে তাদের। এখন গাছ কাটা ও ঘর মেরামত করার চিন্তায় সময় কাটছে তার।
নবীরের মতো হাতিয়ার বিভিন্ন গ্রামে অনেকের ঘর ভেঙেছে গাছের চাপা পড়ে। স্থানীয়রা জানান, বাতাসের যে গতি ছিল, তাতে কাচা ঘারবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। অনেকের ঘর ভেঙেছে গাছ পড়ে।
এদিকে রাতে ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে জোয়ারের তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। স্বাভাবিকরে চেয়েও ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় জোয়ার হয়। এতে সোনাদিয়া ইউনিয়নের হোইকবাদা গ্রামের পাশে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। তাতে এই ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়। সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বেড়ির একটি অংশে প্রায় ১৫ ফুট ভেঙে গেছে। অন্যান্য অংশে জোয়ারের ঢেউয়ের আঘাতে খশে গিয়ে শুধু সামান্য অংশটুকু লেগে আছে। স্থানীয়রা বলছেন বেড়িবাঁধ দ্রুত মেরামত করা না হলে আসছে পূর্ণিমায় প্রায় ৩ কিলোমিটারের পুরোটায় ভেঙে যাবে।
জোয়ারের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে উপজেলার নলচিরাঘাটের পন্টুনটি ভেসে পার্শ্ববর্তী মসজিদের মাঠে উঠে যায়। ঘাটের শ্রমিক বেলাল জানান, ঢেউয়ের আঘাতে এটি তীরে চলে আসে। এ সময় পন্টুনের আঘাতে দুটি দোকান ঘর ভেঙে যায়।
তিন একর জমিতে ইরি ধান চাষ করেন হোইকবাধা গ্রামের কৃষক খোকন মিয়া।বেড়িবাঁধ ভেঙে তার ধানখেতটি প্লাবিত হয়। একদিকে জোয়ারের পানি, অন্যদিকে প্রচণ্ড বাতাসের কারণে খেতের ধান সম্পূর্ণ নুয়ে পড়ে। এতে তিনি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন বলে জানান।
হাতিয়া উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, হাতিয়াতে ইরিধান চাষ হয়েছে ৭৩ হাজার ৮০০ হেক্টর। এর মধ্যে ঝড়ে নুয়ে পড়েছে ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর। সবজি চাষ হয়েছে ৮ শত ৫০ হেক্টর এর মধ্যে নুয়ে পড়েছে ৫ শত ২০ হেক্টর। নুয়ে পড়া এসব সবজি ও ধান আগামী কয়েক দিন রোধ হলে ক্ষতি কম হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বৃষ্টি হলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ও চানন্দী ইউনিয়নে বেড়িবাঁধ নেই। সোমবারের ঝড় ও জোয়ারে এসব ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। নিঝুমদ্বীপ নামার বাজার ১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য কেফায়ের উল্যা জানান, তার ওয়ার্ডের পশ্চিমে নদীর তীরে অনেকে বসবাস করেন। এদের অনেকে বিভিন্ন মাছধরা ট্রলারের শ্রমিক। ঝড়ে এই এলাকায় প্রায় ১০০টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। একদিকে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি, অন্যদিকে প্রচণ্ড ঝড়ে এসব ঘর বিধ্বস্ত হয়। এই বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি তালিকা তৈরি করে উপজেলা পরিষদে জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
নিঝুমদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান দিনাজ উদ্দিন জানান, এখানে বেড়িবাঁধ নেই। তাতে সহজেই রাতের জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় সবকটি ওয়ার্ড। জোয়ারের পানিতে অনেকের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। তবে ঝড়ে বিধ্বস্ত বিদ্যুতের খুঁটি ও লাইন মেরামত করতে না পারায় মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত হাতিয়া পৌরসভার অনেক জায়গা ছিল বিদ্যুতবিহীন।
হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগকে দ্রুত লাইন মেরামত করে বিদ্যুৎ চালু করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তালিকা প্রস্তুত করার জন্য একটি টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন ইউনিয়নে চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি তালিকা তৈরি করবেন। পরে এসব লোকজনকে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।