চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। টানা ছয়দিনের টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ী ঢল ও ফেনী নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে বয়ে যাওয়ায় কয়েকটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে হালদা নদীর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার পর পানির তীব্রতা আরো বাড়ে। এখানে এখানো কার্যত পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) দুপুরের পর থেকে নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে জোরারগঞ্জ, ইছাখালী, কাটাছরা, মিঠানালা ও মঘাদিয়া ইউনিয়ন। এর আগে গত তিনদিন ধরে ভয়াবহ অবস্থায় রয়েছে করেরহাট, হিঙ্গুলী, ধুম ও ওচমানপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। আশ্রয়ন কেন্দ্রগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার সংকট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরসরাই উপজেলার করেরহাট, হিঙ্গুলী, ধুম ও ইছাখালী ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার দিনান্তের মধ্যে অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে গেলেও বাড়ি-ঘর ফেলে যাননি অসংখ্য মানুষ। পরবর্তীতে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২ থেকে এসব এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় উদ্ধার কাজে নানা বিঘœ ঘটছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে বোট নিয়ে এসব এলাকায় উদ্ধার কাজ চালান বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা। তারা এসময় শুকনো খাবারেরও ব্যবস্থা করে। ওইদিন দিবাগত রাতে করেরহাট, বারইয়ারহাট, শুক্রবারইয়াহাট, বাংলাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল, মাদরাসা, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া মানুষকে খাবার সরবরাহ করতে দেখা গেছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।
শুকনো খাবার ও উদ্ধার অভিযানে যাওয়া স্বেচ্ছাসেবী রায়হান ইসলাম জানান, মিরসরাই এবং ফেনীতে পানিবন্দি মানুষকে সহযোগিতা এবং উদ্ধার কাজে দূর দূরান্ত থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবীরা অনেকেই যানজটের কারণে পথেই আটকে রয়েছে।
মিরসরাইয়ের ধুম ইউনিয়নের আনন্দবাজার এলাকায় আটকা পড়ে মোহাম্মদ ফয়সালের বোনের পরিবার। আশ্রয় পেতে মোবাইল একটি নৌকার জন্য বার বার আকুতি জানিয়েও উদ্ধার করতে পারেননি। শুধু ফয়সাল নয়, এভাবে অনেকে আকুতি জানিয়েছেন বন্যার পানিতে আটকে থাকা পরিবারের লোকজন। বিশেষ করে ধুম ইউনিয়নের শুক্রবারইয়ারহাট, মোবারকঘোনা, মিনাবাজার, আনন্দ বাজার এলাকায় শত শত লোক এখনো আটকে রয়েছেন।
মোর্শেদ হোসেন নামে একজন বলেন, আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। আমি দেশের বাইরে রয়েছি। ঘরের সব মোবাইল বন্ধ। তারা কেমন আছে, আল্লাহ ভালো জানেন। মোহাম্মদ সবুজ নামের আরেকজন বলেন, নাহেরপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি পরিবার আটকা পড়েছে। কয়েকটি নৌকার প্রয়োজন, অনেক জায়গায় খোঁজ করেও নৌকা ম্যানেজ করতে পারিনি।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজটের। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেনে এ সড়কে যাতায়াত করা যাত্রী ও চালকরা। জানা গেছে, ফেনীর মুহুরীগঞ্জ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত মহাসড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যা সময় মিরসরাইয়ের জামালের দোকান এলাকায় ঢাকামুখী লেইনে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিলো। সরেজমিনে দেখা গেছে, মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের মিরসরাই সদর থেকে ফেনী পর্যন্ত হাজারও গাড়ি আটকা রয়েছে। উল্টোপথে ত্রাণবাহী গাড়ি যাওয়ার জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। আবার অনেক গাড়ি যানজটে আটকা রয়েছে। ট্রাক চালক সোহেল বলেন, কাল বিকেলে চট্টগ্রাম শহর থেকে মাল বোঝায় করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। এতক্ষণে ঢাকা পৌঁছানোর কথা, কিন্তু এখনো মুহুরীগঞ্জে আটকা রয়েছি। আরেক চালক আরিয়ান রাব্বি বলেন, প্রায় ১৫ ঘণ্টা আটকা রয়েছি। হোটেল বন্ধ থাকায় কোনো খাবার পাচ্ছি না। কখন ঢাকায় পৌঁছাবো বুঝতেছিনা।
যাত্রীবাহী হুন্দাই গাড়ির চালক রবিউল আলম বলেন, ঘন্টার পর ঘণ্টা যাত্রী নিয়ে বসে আছি। যাত্রীরা অনেক কষ্টে আছেন। চট্টগ্রামও ফিরে যেতে পারছি না।
জোরারগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সোহেল সরকার জানান, সড়কে পানির কারণে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ কাজ করেও লাভ হয়নি। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকামুখী লেইনে গাড়ি চলাচল বন্ধ রয়েছে। পানি নেমে গেলে যানজট নিরসন হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম উত্তরজেলা বিএনপির যুগ্ম আহŸায়ক নুরুল আমিন চেয়ারম্যান জানান, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে নেতা-কর্মীরা উদ্ধারের কাজ করছে এবং খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। দলমত নির্বিশেষ সবাইকে উদ্ধার ও খাবার বিতরণে অংশ নেওয়ার অনুরোধ জানান।
উন্নয়ন সংস্থা অপকা’র নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর বলেন, শুক্রবার ৬৭০ জন বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে অপকা’র পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার বিতরন করেছি। শনিবার ১৫’শ মানুষের মাঝে রান্না করা খাবার সরবরাহ করবো।
শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের শীর্ষ শিল্প গ্রæপ ক্লিপটন এর সিইও লায়ন এমডিএম মহিউদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী মিরসরাই উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় কয়েক ট্রাক শুকনো খাবার নিয়ে বন্যা দুর্গত এলাকায় যান এবং সেখানে তিনি খাবার বিতরণ করেন।
মিরসরাই উপজেলা বিএনপির আহŸায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী, মিরসরাই উপজেলা জামায়াতের আমির নুরুল করিমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও উদ্ধার ও শুকনো খাবার বিতরণ করছেন বিভিন্ন এলাকায়।
মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসক মাহফুজা জেরিন জানান, বৃহস্পতিবারের তুলনায় শুক্রবার পানির তীব্রতা বেড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ সেবা বিচ্ছিন্ন, এখানে মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। এতে উদ্ধারের নিশ্চিত সংবাদ পাওয়া দূরহ হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী, রেডক্রিসেন্ট, ফায়ারসার্ভিস স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে। উপজেলার প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিয়ন পরিষদ, সাইক্লোন শেল্টার সহ সরকারি ভবনগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনা খাবার বিতরণের জন্য উপজেলায় কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। যেখানে সংকট দেখা দিচ্ছে দ্রæত আমরা খাবার পৌঁছে দিচ্ছি।