ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় লিবিয়া পাড়ি দিতে চেয়েছিলেন মিরসরাইয়ের আজমির হোসেন মিঠু এবং আবদুল্লাহ আল জোবায়ের। দালালের খপ্পরে পড়ে সব কিছু হারিয়ে সে স্বপ্ন অধরা থেকে গেল। দেশে ফিরেছে ন্যাডা মাথায় কঙ্কালসার দেহ আর এক ঝুড়ি নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে। বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফেরা আজমির হোসেন মিঠু ১নং করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম অলিনগর এলাকার মো. দিদারুল আলমের ছেলে ও আবদুল্লাহ আল জোবায়ের (২৪) উপজেলার ২নং হিঙ্গুলী ইউনিয়নের দক্ষিণ আজম নগর এলাকার বাসিন্দা।
জানা গেছে, আজমির হোসেন মিঠুর মা আফরোজ বেগম ধার-দেনা করে ছেলেকে লিবিয়া পাঠানোর জন্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা ও ঘরের গরু বিক্রি করে দফায় দফায় দালালের হাতে টাকা তুলে দেন। মূলত দুবাই থেকে মিশর হয়ে ছেলেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দেবে এমনটাই কথা ছিল। সেখান থেকে যাবে ইতালি। নিয়তির নির্মম পরিহাসে বাড়ি থেকে বের হওয়ার ৪১ দিনের মাথায় লিবিয়ায় বন্দী দশা থেকে ন্যাডা মাথায় কঙ্কালসার দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে ছেলে আজমির হোসেন মিঠু। সেই সাথে হারালো ধারের ৬ লাখ টাকা।
এ ঘটনায় বাড়ি ফিরে আজমির হোসেন মিঠু বাদি হয়ে শাহাদাৎ হোসেন, তার ভাই আজাদ হোসেন, সজিব (২৮), আজিম, নুরুল করিম ও বিবি জহুরাসহ ছয় জনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
আজমির হোসেন মিঠু জানায়, এক বোন দুই ভাইয়ের মধ্যে সে ২য়। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে। এরপর বাড়ির পাশে বাবার চায়ের দোকানে সাহায্য করতো। বছর খানেক আগে একই এলাকার লিবিয়া প্রবাসী শাহাদাৎ হোসেন তাকে ৫০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতে লিবিয়া নিয়ে যাওয়ার নানা প্রলোভন দেখাতে থাকে তার মাকে। সংসারের অভাবের কথা ভেবে মা দেলাফরোজ বেগম রাজি হন ছেলেকে ইতালি পাঠাতে। এজন্য বাড়িতে বাবা মাকে পাঠিয়ে আগাম দেড় লাখ টাকাও নিয়ে যায় শাহাদাৎ হোসেন। পরে লিবিয়ায় থাকা শাহাদাতের নির্দেশনা মতে কাগজপত্র জোগাড় করে গত ২১ মার্চ দুবাই পৌঁছায়। বিমানবন্দরে শাহাদাতের লোকজন রিসিভ করে গাড়িতে তুলে গলি গুপচির ভেতর ছোট একটি কক্ষে ৩০-৩৫ জনকে একসাথে রাখে। সেখানে দুইদিন রেখে একটি ফ্লাইটে করে নিয়ে যায় মিশর। মিশরে বিমান বন্দর এলাকায় গুদাম ঘরের মত একটি স্থানে ২৪ ঘন্টা রেখে আরেকটি বিমানে তুলে নিয়ে যায় লিবিয়া। লিবিয়াতে পৌঁছার পরই বদলে যায় শাহাদাতের আচরণ। এখান থেকে ওখানে বারবার স্থান বদলায় আমার। চাকরি দেয়ার কথ বললেই চলে মারধর। এদিকে বাড়িতে ফোন করে করে ধাপে ধাপে আদায় করে নেয় ৬ লাখ টাকা।
আজমির হোসেন মিঠু বলেন, লিবিয়া পৌঁছানোর পরই আমাদের সবার পাসপোর্ট কেড়ে নেয়া হয়। বাড়ি থেকে ছয় লাখ টাকা আদায়ের পর শাহাদাত আমাকে চড়া দামে আরেক পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেয়। একদিন সেই পক্ষের হাতে তুলে দিতে লিবিয়ার একটি মরুভ‚মিতে ফেলে আসে আমাকে। সেবার এক লিবিয় নাগরিকের সহায়তায় রক্ষা পেয়ে পরিচিত এক বাংলাদেশির আশ্রয় নিই। খবর পেয়ে শাহাদাত আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে। এনে একটি কক্ষে আটকে রেখে আমি কেন পালিয়ে যেতে চেয়েছি তা বলে ওর ছোট ভাই আজাদ হোসেন, সজিব ও আজিমসহ আরো কয়েকজন মিলে নিয়মিত মারধর করে। সেখানে আট দিন অনাহারে থাকার পর জানালার কাচ ভেঙ্গে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে যাই। অনেক কষ্টে ফোনে বিষয়টি বাড়িতে জানালে মা এলাকার ইউপি সদস্যের মাধ্যমে শাহাদাতকে আমাকে বাড়িতে পাঠানোর অনুরোধ করে। এরপর তারা আবার আমাকে খুঁজে বের করে এনে একদিন সড়কের পাশে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ির নিচে ফেলে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। সেখানে এক লিবিয় চালক আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করালে সেখানে এক সপ্তাহ চিকিৎসা নেয়ার পর শাহাদাত আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায়। বাড়িতে বিষয়টি জানাজানি হলে সে আমার উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে একদিন লিবিয়ায় আমি ভালো আছি তা বোঝাতে দুই ভাই চাপাতি নিয়ে দুপাশে বসে বাড়িতে ভিডিও কল করে। আমাকে বলে বলবি, এখানে বেশ ভালো আছিস তুই। আমি সেভাবে বলতে বাধ্য হই। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গত ৫ মে ন্যাড়া মাথায় মূমুর্ষ অবস্থায় বাড়ি আসি আমি। ফাঁদ পেতে মানুষ ধরা ওদের পেশা। আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই চক্রের হাতে প্রতারিত আরেক যুবক আবদুল্লাহ আল জোবায়ের বলেন, চট্টগ্রামের মহসীন কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বিরতি পড়ে আমার। শাহাদাতের ছোট ভাই চক্রের সদস্য আজাদ হোসেন আমার বন্ধু। ওর কথা বিশ্বাস করে এ পথে পা বাড়িয়েছিলাম। আমার বাবা কুয়েত প্রবাসী। বারইয়ারহাটে আমাদের পারিবারিক ব্যাবসা ছিলো। আমাকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে যায়। আজিমের সাথে যা হয়েছে তেমনি হয়েছে আমার সাথে। ওই চক্রের সদস্য অনেক। বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা প্রবাসীরা ওদের টার্গেট। ভালো চাকরি বা ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে লিবিয়া নিয়ে জিম্মি করে পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করাই হচ্ছে ওদের কাজ। আমার পরিবারের কাছ থেকে চার লাখ টাকা আদায় করেছে ওরা। অনুরোধ করবো এই মানব পাচারকারিদের পাল্লায় পড়ে আর কেউ যাতে লিবিয়া না যায়। এ ঘটনায় আমি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতারণার শিকার আজিম হোসেন মিঠুর মা আফরোজ বেগম বলেন, আমি শেষ হয়ে গেছি। ভালো চাকরির কথা বলে আমার ছেলেকে লিবিয়া নিয়ে অত্যাচার করে ওর জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমার এখন ছয় লাখ টাকা দেনা। মাথায় আঘাত করায় ছেলে এখন মানসিক রোগী হয়ে গেছে। ছেলের শোকে ওর বাবা দুইবার ব্রেনস্ট্রোক করেছে। আমার পরিবার এলোমেলো করে দিয়েছে ওরা। আমি এ অন্যায়ে বিচার চাই।
যোগাযোগ করা হলে করেরহাট ইউনিয়ন পরিষদের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আজাদ উদ্দিন বলেন, লিবিয়া প্রবাসী শাহাদাত হোসেন একই এলাকার আজমির উদ্দিন মিঠুকে ভালো চাকরি দেয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে প্রতারণা ও অত্যাচারের বিষয়টি আমি জানি। আজমিরকে দেশে ফেরাতে আমি ফোনে বেশ কয়েকবার শাহাদাতের সাথে কথা বলেছি। ভিডিও কলে সেখানে মারধরে আজমিরের মাথা ফুলাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। এ ঘটনায় আজমির বাদি হয়ে আদালতে মামলা করেছে।
মামলাটির আইনজীবী অনিমেশ কুমার সোম বলেন, লিবিয়াতে জালজালিয়াতি ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে মর্মে একটি ফোজদারি মামলা দায়ের করেছে। বিজ্ঞ আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে সেটি তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছে।