আজ শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ই চৈত্র ১৪৩০

লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা: ১২ বছরে চার রিট, সবই শুনানির অপেক্ষায়

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : শুক্রবার ২৬ অগাস্ট ২০২২ ০২:৫৫:০০ অপরাহ্ন | আইন-আদালত

 

চলতি বছরের ২৯ জুলাই। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া এলাকায় রেললাইনে উঠে যাওয়া মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দেয় ট্রেন। এতে মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হন। ২১ জুলাই রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের ধাক্কায় পাঁচ নির্মাণশ্রমিক নিহত হন গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার কাগদী লেভেল ক্রসিংয়ে। দুই ঘটনায়ই আহত হন বেশ কয়েকজন।

২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটে গেটম্যানবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন ও ট্রাকের সংঘর্ষে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ১৪ জনের। একইভাবে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের বর-কনেসহ ১১ জন নিহত হন ২০১৯ সালে।

সারাদেশে রেললাইনে বৈধ ও অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৬৫টি। এর মধ্যে এক হাজার ৩৬১টির কোনো অনুমোদন নেই। আবার এক হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টির গেটম্যান নেই। এসব বৈধ ও অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে নিয়মিতই ঘটছে দুর্ঘটনা। নিহত ও আহত হচ্ছে মানুষ।

এ কারণে লেভেল ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও গেটম্যান নিয়োগ, দুর্ঘটনার কারণ ও জড়িতদের খুঁজে বের করা এবং নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে গত ১২ বছরে হাইকোর্টে পৃথক রিট হয়েছে। সবগুলো রিটই রয়েছে শুনানির অপেক্ষায়।

তিন বছর আগে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের বর-কনেসহ ১১ জন নিহতের ঘটনায় রিট হয়েছিল। সেই রিটে লেভেল ক্রসিংয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও গেটম্যান নিয়োগের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। রিট আবেদন করেছিলেন অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া।

রিটকারী অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া এ বিষয়ে বলেন, ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর রুল জারি করার বেশ কিছুদিন পর রুলটি শুনানির জন্য উত্থাপন করা হয়েছিল। হাইকোর্ট অবৈধ লেভেল ক্রসিং বন্ধ, লেভেল ক্রসিং নিরাপদ করতে পদক্ষেপ নিয়ে তিনমাসের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই অগ্রগতি প্রতিবেদন কেউ দাখিল করেনি।

তবে তার পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে রুল শুনানি করা যায়নি। এই রুল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাটে লেভেল ক্রসিংয়ে ১৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় রিট করা হয়েছিল গেটম্যান নিয়োগের নির্দেশনা চেয়ে। রিটের পরে রুলও জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। ওই রুলের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রতিবেদন এসেছিল। কিন্তু সেই প্রতিবেদন ও রুলের শুনানি এখনো হয়নি।

সেই রিটটি করেছিলেন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকট মনজিল মোরসেদ।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারির পাশাপাশি রেলপথে কতগুলো ক্রসিং, বৈধ কত এবং অবৈধ কত, ক্রসিংয়ে গেটম্যান আছে কি না- এসব বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বলেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু লেভেল ক্রসিংয়ের এই দুর্ঘটনা রোধে প্রায় ১২ বছরের বেশি সময় আগে হাইকোর্টের জারি করা রুল আজও নিষ্পত্তি হয়নি।

এ নিয়ে অ্যাডভোকট মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রায়ই রেল দুর্ঘটনা হয়। অনেক ক্রসিং আছে যেগুলোতে লোকবলও নাই, কোনো ধরনের ব্যারিকেডও নাই। আমাদের রিটটি ছিল যে, সব জায়গাগুলোতে (লেভেল ক্রসিং) যেন লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনায় সারাদেশের রেলপথে কতগুলো ক্রসিং আছে সেই তালিকা চাওয়া হয়েছিল। তালিকাও প্রস্তুত করেছিল রেলওয়ে।

তিনি বলেন, আমাদের রিটটি সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বেঞ্চে শুনানি ও আদেশ হয়েছিল। পরে তিনি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের ওপর শুনানি করতে চাইলে রেলওয়ের আইনজীবী সময় নিলেন। উনারা বললেন ক্রসিং কতগুলো এবং লোকবল নিয়োগ দিতে অনেক ফান্ডের দরকার, প্রস্তুতিও দরকার। পরবর্তীসময়ে হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন আপিল বিভাগে চলে যাওয়ার কারণে সেই বেঞ্চ ভেঙে গেলো। এসব কারণে আর মামলাটি শুনানি হয়নি।

ওই রিটের বিষয়ে আবার শুনানির উদ্যোগ নেবেন বলে জানান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

এদিকে গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার পরে সারাদেশের ক্রসিংগুলোতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত ও নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে।

গত ৩ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল এ রিট করেন। রিটের বিষয়ে গত ৪ আগস্ট শুনানি করতে গেলে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ তাতে অপারগতা প্রকাশ করে ফিরিয়ে দেন। পরে এ বিষয়ে আর শুনানি হয়নি।

এ নিয়ে রিটকারী আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, রিটটি আমরা হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানির জন্য উপস্থাপন করেছিলাম। আদালত সেটি ‘আউট অব লিস্ট’ করেছেন। এখন আমরা রিটটি শুনানির জন্য অন্য কোনো হাইকোর্ট বেঞ্চে আর্জি জানাবো।

এছাড়া গত ২১ জুলাই রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেসের ধাক্কায় পাঁচ নির্মাণশ্রমিক নিহত হন। এরপর ৩১ জুলাই আইনজীবী তাপস কান্তি বল এ দুর্ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং নিহত-আহতদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ চেয়েছিলেন। পরে আদালত তাকে রিট করার পরামর্শ দেন। তার ধারাবাহিকতায় রিট হলেও সেটি শুনানি হয়নি।

এসব লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এবং রিট নিয়ে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর পল্লব বলেন, রেল দুর্ঘটনায় নিহত যাত্রীদের বিষয়ে কোনো ইন্স্যুরেন্স আইন করা যায় কি না সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ ও আলোচনা করে উদ্যোগ নেবো। এমন না যে রেল দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করার সুযোগ রেল কর্তৃপক্ষের নেই। রেল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলার কারণেই প্রতি বছর শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। যেভাবে ক্রসিংয়ের দুর্ঘটনায় মানুষ জীবন দিচ্ছে, তাতে কোনো প্রতিকার নেই। একটা সভ্য সমাজে এ ধরনের একটা পরিস্থিতি, এ ধরনের দুর্ঘটনা চলতে পারে না।

তিনি বলেন, আইনে বলা হচ্ছে যে, রেল অথরিটি অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোথাও ক্রসিং করা যাবে না। অনুমতি লাগবে, অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণলয় সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় রেললাইনের জায়গায় ক্রসিংগুলো নিজের ইচ্ছেমতো করছে। এটার কোনো অনুমোদন নেই এবং সেখানে কোনো গেটম্যান নেই। পুরোটাই হচ্ছে আইনকে পাস কাটিয়ে। এসব আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, বিশেষ করে রেল কর্তৃপক্ষের অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। দেখতে হবে এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।

এটা অন্যান্য দেশে কল্পনাও করা যায় না বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।