লামায় রাবার বাগানের নামে দখল করা জমিসহ আদিবাসীদের সব জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছে চট্টগ্রামের এক নাগরিক সমাবেশ থেকে। আদিবাসীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, সাংবাদিকসহ পেশাজীবীরা সমাবেশ থেকে এ দাবি জানান।
পরিবেশবাদী নাগরিক সংগঠন পিপল’স ভয়েস ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম শুক্রবার (৩ জুন) বিকেলে নগরের চেরাগি পাহাড় মোড়ে এ নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করে।
সমাবেশে লামার ঢেংগে ছড়া নতুন পাড়া, লাংকম পাড়া ও রেংয়েন ম্রো পাড়ার কারবারিসহ বাসিন্দারা ঘটনার দিনের বর্ণনা দেন। তারা বলেন, জুম ভূমি পুড়িয়ে দেওয়ায় তারা বর্তমানে কোনো চাষাবাদ করতে পারছেন না। তারা এখন ভূমি হারিয়ে ভবিষ্যতের চিন্তায় দিশেহারা।
সমাবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আলাউদ্দিন বলেন, এ লজ্জা সরকারের, যারা দুই দশক আগে চুক্তি করেছে। যার জমি তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সব অর্জন ব্যর্থ হবে যদি আদিবাসীদের অধিকার আমরা রক্ষা করতে না পারি।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, একাত্তরে প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল এ প্রত্যাশায় যে দেশে কোনো শোষণ নিপীড়ন থাকবে না। কিন্তু নিষ্ঠুর পুঁজিবাদ আর মুনাফা প্রবণতার মুনাফাখোরদের হাতে মানুষ আজ বন্দি। রাবার বাগানের নামে পাহাড়ের ভূমি বছরের পর বছর ধরে দখল করে চলেছে। কাউকে নিজ মাটি থেকে উৎখাত করা বর্বরতা। আর তারা প্রতিবাদ করলে হয়ে যায় সন্ত্রাস। সেখানে প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারী প্রভুর মতো আচরণ করে। পাহাড়ি জনপদের আত্মপরিচয় বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে। আইওয়াশ নয় তাদের স্বাধীন জীবনাচরণের অধিকার চাই। যারা সংখ্যায় কম তাদের রাষ্ট্রের আনুকুল্য দিতে হবে। পাহাড়ে কেউ থাকতে চাইলে পাহাড়ের মানুষকে সম্মান করতে হবে।
অধ্যাপক অশোক সাহা বলেন, সমতলে যেমন পাহাড়েও তেমনি নানা নির্যাতন আছে। পাহাড়ে চলছে ভূমিদস্যুতা। ভূমিদস্যুরা এখন রাজনীতি করে বড় চেয়ারে চলে যায়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবার সোচ্চার হওয়া উচিত। যৌক্তিক পরিণতি পর্যন্ত এ সংগ্রাম চলবে।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সভাপতি তাপস হোড় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এই দেশে কারো দাম্ভিকতাকে মানুষ বরদাশত করবে না। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের ওপর নির্যাতন করে তবে নাগরিকরা প্রতিবাদ করতে সংগঠিত হতেই পারে। তখন কী ব্যবস্থা নেবেন তা রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বারবার অধিকার হরণ চলতে পারে না। নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী বলেন, মনে রাখবেন এদেশে আদিবাসীরা একা নন আমরাও আপনাদের সঙ্গে আছি। কবি কামরুল হাসান বাদল বলেন, আজ যে প্রতিবাদ এমন বাস্তবতার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। আপনাদের ওপর যে আগ্রাসন, জাতিগত নিপীড়ন তার জন্য বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমি লজ্জিত, ক্ষমাপ্রার্থী। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিল জিয়াউর রহমান। সেই বিষবৃক্ষ ডালপালা মেলে মহীরূহ হয়েছে। পাহাড়ের উন্নয়নের নামে পরিবেশ বিধ্বংসী কাজ হচ্ছে। ভূমির প্রকৃতি পাল্টে দেওয়া হচ্ছে। পাঁচতারকা হোটেল হচ্ছে। আদি নাম মুছে দিয়ে অনেক বড় পাপ করছেন। বুকের রক্ত দিয়ে ভাষা ও স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা বাঙালি যদি কারো অধিকার হরণ করে তার থেকে খারাপ কিছু হয় না। প্রতিটি মানুষের জন্মভিটা, মাতৃভাষা রক্ষার অধিকার হচ্ছে। সে অধিকার রক্ষার লড়াই অব্যাহত থাকুক।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে পিপল’স ভয়েস সভাপতি শরীফ চৌহান বলেন, আদিবাসীদের জমি কেউ জবরদখল করতে পারবে না। দখলকৃত ভূমি অবশ্যই ফিরিয়ে দিতে হবে। যে ফসল সেসব জমিতে ছিল তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সংকট মোচনে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি প্রণয়ন করা হয় তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। চুক্তির অন্যতম শর্ত ভূমি বিরোধ নিরসন। ভূমি কমিশনের আজ পর্যন্ত কোনো কার্যক্রম নেই। অবিলম্বে কমিশনের কাজ শুরু করে তাদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।
আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে কোনো শিল্পায়ন মেনে নেওয়া হবে না। অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অব্যাহত সামাজিক রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পাহাড়িদের পাশে দাঁড়ানো উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের অধিকারের কথা মুখে বললেও তারা পাহাড়ের মানুষের অধিকারের কথা বলেন না। পাহাড়ে যে অত্যাচার নিপীড়ন তা নিয়ে কিছু বলে না। এ সমস্যার সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। পাহাড়ে ও সমতলে মানুষের অধিকার রক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রতিবাদ অব্যাহত থাকলে অবশ্যই নিজের অধিকার রক্ষা পাবে।
সমাবেশে পিসিপি ছাত্র পরিষদ মহানগরের সাধারণ সম্পাদক বিনিময় চাকমা বলেন, আমাদের মূলভিত্তি জুমঘর। সেই জুমঘর পুড়িয়ে দিলে পাহাড়ের মানুষ কোথায় যাবে। উন্নয়ন করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের কথা শুনতে হবে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির লঙ্ঘন করে বারবার জমি দখল করা হচ্ছে। মূল হোতাদের গ্রেফতার ও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। পাহাড়ি শ্রমিক কল্যাণ ফোরামের সহ-সভাপতি অনিল চাকমা বলেন, চুক্তি বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে। জুম্ম জনগণের অধিকারের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চলবে।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি সুপ্রিয় তংচংগ্যার সঞ্চালনায় সমাবেশে সিআরবি রক্ষা মঞ্চের মহিম উদ্দিন, ত্রিপুরা কল্যাণ ফোরামের সভাপতি সুরেশ বরণ ত্রিপুরা, ব্রাইট ফোরাম ফর বাংলাদেশের উৎপল বড়ুয়া, লেখক শিপ্রা দাশ, বাংলাদেশ ম্রো স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের তং প্রং মো, চবি ছাত্র নরেশ চাকমা, লাংকম পাড়ার কারবারি লাংকম, পাড়াবাসী ইয় চং ম্রো, ঢেংগে ছড়া নতুন পাড়ার কারবারি রেংয়েন প্রমুখ সমাবেশে সংহতি জানান।