আজ শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

টানেলে সাদা হাতি : কাজে আসছে না সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার বিলাসবহুল অতিথিশালা

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশের সময় : শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৪৬:০০ পূর্বাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত টানেলের দক্ষিণ প্রান্তে পারকি খালের পাশে সাড়ে ৪ শত কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ হাজার বর্গফুট আয়তনের জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে ৭ তারকা মানের সুসজ্জিত এক বাংলো। এই ধরনের বাংলো প্রকল্পকে অর্থনীতির ভাষায় সাধারণ ‘শ্বেত হস্তি’ বা বিলাসী 'সাদা হাতি' বলা হয়ে থাকে। এই বিলাসবহুল অতিথিশালা এখন ফাঁকা পড়ে আছে।

সেতু বিভাগ বলছে, অতিথিশালা তৈরি হলেও তা কখনোই চালু হয়নি। কারণ সেটা চালু করার মতো জনবল নেই। যদিও ব্যয় করা হয়েছে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার মতো। টানেল নির্মাণ প্রকল্পে যে জায়গায় অতিথিশালা নির্মাণ করা হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ‘সার্ভিস এরিয়া’। প্রকল্পের শুরুতে ‘সার্ভিস এরিয়া’ ছিল না। মাঝপথে তা যুক্ত করে প্রায় ৭২ একর জায়গাজুড়ে নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে সমুদ্রসৈকত। অদূরে পর্যটন করপোরেশন আরেক প্রকল্প।

সড়ক পরিবহন ও সেতু বিভাগের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান টানেলের লোকসান কমাতে কিছুদিন আগে উদ্যোগ নিয়ে জানিয়েছিলেন, টানেল প্রকল্পের আওতায় নির্মিত অতিথিশালা সেভেন স্টার মানের। এমনিতে যৌক্তিকতা বিবেচনা না করে টানেল নির্মাণ করা হয়েছে। এরপর ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। টানেল নির্মাণে শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। পরে শর্তের চীনা ঋণে নেয়া প্রকল্পের ব্যয় তিন দফা বাড়ানোর পর ব্যয় দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকায়।

সুসজ্জিত এই এক বাংলোতে রয়েছে ৬টি বিশাল কক্ষ। রয়েছে সুইমিংপুল। সার্ভিস এরিয়া জুড়ে বাংলো ও রেস্টহাউস ছাড়া রয়েছে টানেলের একটি রেপ্লিকা, সম্মেলনকেন্দ্র, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হেলিপ্যাড, মসজিদ, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন। আরও রয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্য ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে একটি জাদুঘর। 

এসব স্থাপনায় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা বসানো হয়েছে ১ হাজার ১৮২ টন ক্ষমতার এসি। সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, টানেল প্রকল্পের শেষ সময়ে অতিথিশালা যুক্ত করার নেপথ্যে ছিলেন তখনকার সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এই অতিথিশালা ছাড়াও নির্মাণ করা হয়েছে ৩০টি রেস্টহাউস (বিশ্রামাগার)।

যদিও সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, এটি নির্মাণের পেছনের কারণ ছিলো, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সফরের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। প্রকল্প কর্মকর্তাদের ধারণা ছিল, প্রধানমন্ত্রী সফরে গেলে তিনি এখানে অবস্থান করবেন। তবে বাস্তবে অতিথিশালাটি কোনো কাজে আসেনি। বর্তমানে সেই অতিথিশালাটি অলস পড়ে রয়েছে। আর টানেলেও প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে বিপুল লোকসান।

সূত্র আরো জানায়, অতিথিশালাসহ সার্ভিস এলাকা নির্মাণের সিদ্ধান্তের পরই দ্বিতীয় দফায় জরুরি ভিত্তিতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছর জানুয়ারিতে পুনরায় ৩১৫ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন ব্যয় বৃদ্ধির একটা কারণ। তবে বড় কারণ হলো অতিথিশালার তৈজসপত্র, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, আসবাব ও গৃহসজ্জা সামগ্রী কেনা। 

সামনে আরো লোকসানের মুখে পতিত হবে যে কারণে সেটি হলো, পারকি সৈকতের পাশে পর্যটন করপোরেশন ১৩ একর জমিতে ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি পর্যটন কমপ্লেক্স নির্মাণ করছে। সেখানে থাকবে ১০টি একক কটেজ, চারটি ডুপ্লেক্স কটেজ, এবং একটি বহুমুখী ব্যবহার ভবন। 

এছাড়া হ্রদ, শিশুদের খেলার জায়গা, এবং অন্যান্য সুবিধা থাকবে। পর্যটন কমপ্লেক্সটি টানেলের মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, পর্যটন কমপ্লেক্স যথেষ্ট হওয়ায় বিলাসবহুল অতিথিশালাটির কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ একই স্পটে দুটি বিলাসী বিনোদন স্পট। সরকারের বাড়তি ব্যয় বলে মনে করছেন। 

অথচ কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ১২ হাজার কোটি টাকা খরচে নির্মিত টানেলে দৈনিক আয় হচ্ছে মাত্র ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা এবং দিনে ব্যয় হচ্ছে ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। সে হিসাবে আয় ব্যয় মিলাতে গেলে দেখা যায়, মাসে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা (প্রায়)।

টানেল কর্তৃপক্ষের হিসাব বলছে, প্রতিদিন গড়ে টানেল দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে তিন হাজার ৯১০টি। টানেল কর্তৃপক্ষের দেয়া হিসাব বলছে, এখন পর্যন্ত গত এক বছরে এই টানেল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। যেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেল থেকে টোল বাবদ আয় হচ্ছে ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

কিন্তু মাটির তলদেশে নির্মিত টানেল হওয়ায় প্রতিদিন টানেলে কৃত্রিম অক্সিজেন ও আলো সরবরাহ, সামগ্রিক নিরাপত্তা ও জরুরি নিরাপত্তা বাবদ একটা বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রতিদিন গড়ে টানেলটির এসব ব্যয় নির্বাহে খরচ হচ্ছে প্রায় ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকা।

ঋণের টাকায় নির্মিত হওয়ায় এই প্রকল্প থেকে থেকে আয় তো দূরের কথা, প্রতিদিনের ব্যয়ও তোলা সম্ভব না হওয়ায় টানেলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সেক্ষেত্রে শাহ আমানত তৃতীয় সেতুর টোলপ্লাজায় বেশ সচল। আদায়ও টানেল অপেক্ষা খরচসহ সব মিলিয়ে সন্তোষজনক বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম জানান, ‘টানেল নির্মাণ হচ্ছে একটি দূরদর্শী প্রকল্প। এটির পরিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য মিরসরাই শিল্পনগর থেকে আনোয়ারা-বাঁশখালী হয়ে পেকুয়া মাতারবাড়ী কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করতে হবে। এই এলাকাজুড়ে শিল্পায়ন, পর্যটন ও আবাসন এলাকা গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে। তবে সময় লাগবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এবং মিরসরাই শিল্পাঞ্চল চালু হলে টানেলের ব্যবহার আরও বাড়বে। এটা আগামী ১০০ বছর ধরে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে। সেদিক থেকে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই তা বলা যাবে না। তবে প্রকল্পের খরচ নিয়ে প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন।’

একই বিষয়ে অধ্যাপক সামসুল হক বলেন, ‘টানেলটি চালুর পর বাইসাইকেল, সিএনজি ও মোটর সাইকেলের মতো যানবাহনগুলো চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। ফলে সার্বজনীন না হওয়ায় পরিবহনের সংখ্যা কমছে। এছাড়া কর্ণফুলী টানেলের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে শাহ আমানত সেতু। এ সেতুর তুলনায় কর্ণফুলী টানেলের টোল হার যানবাহন ভেদে আড়াই থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্য টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।’

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান জানান, ‘বন্দর নগরী ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে এই একটি টানেল কতটা দরকার ছিল, তা নিয়ে নীতিনির্ধারকরা সঠিকভাবে পর্যালোচনা করেননি। যেহেতু প্রকল্পের ব্যয় বেশি, তাই এখান থেকে কোনোদিন প্রত্যাশিত আয় হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’

কর্ণফুলী টানেল সাইট কার্যালয়ে কর্মরত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উপ প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল কালাম আজাদ জানান, ‘টানেল একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটিকে লোকসানি প্রকল্প বলা যাবে না।’

টানেলের ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, 'ধীরে হলেও টানেল থেকে আয় বাড়ছে। পরিচালন ব্যয় কত হয়েছে-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সেই হিসাব আমার কাছে নেই। এর বাহিরে আমি কিছু বলতে পারব না।'

টানেল প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, 'টানেলে যানবাহন চলছে। গাড়ির সংখ্যাও বাড়ছে। টানেলে টোল খাত থেকেই আয় হবে। এ ছাড়া আয়ের অন্য কোনো খাত নেই। তবে এখনো পরিচালন খাতে ব্যয় বেশি।'

টানেলের সার্ভিস এরিয়ায় দায়িত্বরত মেসার্স নায় এন্টারপ্রাইজ এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শহিদুল ইত্যাদি বলেন, 'আমি জাস্ট চাকরি করি। মিডিয়ায় মন্তব্য দেওয়ার মতো কতৃপক্ষ রয়েছেন। দয়া করে কতৃপক্ষের সাথে কথা বলুন।'

অপরদিকে, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন, অতিথিশালাটি বেসরকারি খাতে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া যায় কি না। যাতে এটি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে কিছু আয় হবে। তাতে টানেলের লোকসান কমানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে।

প্রসঙ্গত, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বন্দর নগরকে চীনের সাংহাইয়ের মতো ‘ওয়ান সিটি, টু টাউন’ মডেলে পরিণত করার কথা বলে টানেল প্রকল্প নেয়। টানেলটি দক্ষিণ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করেছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৫ সালের নভেম্বরে।

সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি (জিটুজি) পদ্ধতিতে চীনের অর্থায়নে এবং ওই দেশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টানেলটি নির্মাণ করেছে। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা। যদিও চীনের ঋণচুক্তি সম্পাদনে দেরি হওয়ায়  টানেলের নির্মাণকাজ শুরু হয় আরো দুই বছর পর। আর জমি অধিগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি, শুল্ক–করহার বৃদ্ধি, পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তর ইত্যাদি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে ২০২০ সালে নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। 

২০২১ সালে জরুরি ভিত্তিতে আরো ৪৯৪ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধি করে কর্তৃপক্ষ। এতে ব্যয় দাঁড়ায় মোট ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। টানেলটি ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হয়। 

কর্ণফুলী টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৩২ কিলোমিটার। এই সুড়ঙ্গটি বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এই সুড়ঙ্গের নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে সুড়ঙ্গটি ১৫০ ফুট গভীরে অবস্থিত।

২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিন পিং এর ঢাকা সফরে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী চীনের এক্সিম ব্যাংক ২০ বছর মেয়াদি ঋণ হিসাবে দুই শতাংশ সুদে ঋণ দেন। বাকি অর্থায়ন দেশের।