
• শুষ্ক মৌসুমে প্রতিবছর 'লাইন পরিষ্কার' এর নামে আগুন লাগানো হয়।
• বাগান পরিষ্কার করতে নিজেরা আগুন লাগাই- এজিএম রুহুল আমিন।
• মাটি, ফসল ও এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে- কৃষি অফিসার হাসানুজ্জামান
ঝড়া পাতা ও জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে পুড়ানো হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহত দাঁতমারা রাবার বাগান। আগুনের অতিরিক্ত তাপে উৎপাদন ক্ষমতা হারাচ্ছে রাবার গাছ। ঝাঁকে ঝাঁকে মরছে পরিবেশ রক্ষাকারী নানা প্রজাতির কীট পতঙ্গ ও বনপ্রাণী। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।
গত শনিবার বিকালে ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা রাবার বাগান এলাকায় সরেজমিনে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। বাগানের কয়েকজন শ্রমিক আগুনের লাঠির শিখা হাতে নিয়ে বাগানে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন। আবার সচেতন কেউ কেউ আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে সেখানে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন।
শুধু দাঁতমারা রাবার বাগান নয়, এভাবে শুষ্ক মৌসুমে 'লাইন পরিষ্কার' এর নামে কাঞ্চন নগর, রাঙ্গামাটিয়া, দাঁতমারা, তাঁরাখোসহ বিভিন্ন রাবার বাগান কর্তৃপক্ষের এবং দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়ে বিপন্ন হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও কীটপতঙ্গ। বিভিন্ন টিলার ও সড়কের লাইন পরিষ্কার করতে আগুন দেয়ার কথা স্বীকার করে রাবার বাগান কর্তৃপক্ষের এজিএম রুহুল আমিন। তিনি মুঠোফোনে বলেন, 'অনেক স্থানে লাইন পরিষ্কার করতে আমরা নিজেরাই আগুন লাগাই। আবার আমরাই প্রতিরোধ করি। বন্যপ্রাণী কীটপতঙ্গ নষ্ট হবার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এটি খতিয়ে দেখবেন বলে জানান।'
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাবার বাগান এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পাখি, বিরল প্রজাতির কাঠবিড়ালি, বানর, খরগোশ, বন মোরগ, বেজি, খেকশিয়াল, টিয়া, ময়না, ঘুঘুসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বসবাস। রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ প্রতি বছরই বাগান সম্প্রসারণ করতে এবং টিলা পরিষ্কার করতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আবার এক শ্রেণির স্থানীয় দুর্বৃত্ত এসে পাতার স্তূপে আগুন লাগায়। আগুনে বনে থাকা পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ পুড়ে যায়। এ ছাড়া মারা পড়ে মাটির কেঁচো ও অণুজীব। নষ্ট হয়ে যায় পশুপাখির আবাসস্থল। স্থায়ী বাসস্থান হারিয়ে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে এসেও হত্যার শিকার হয়। প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে এ আগুন লাগার ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় বাসিন্দা দাঁতমারা গ্রামের মুহাম্মদ আবদুল গণি বলেন, "শীতের শুরু থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বাগানের অভ্যন্তরে প্রতিদিন বিকেলে আগুন লাগানো হয়। এতে বড় গাছগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। আমরা বাগান কর্তৃপক্ষকে পরিবেশের হুমকির বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু তারা এসব কথায় কান দেন না।”
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০১০ সালের দিকে উপজেলার এসব বাগানে আগুন লাগানোর বিষয়টিকে জীব বৈচিত্র্যের জন্য সংকটাপন্ন বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। জীববৈচিত্র্য নিধন বন্ধে এ ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একটি চক্র নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলার পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ সাংবাদিক সমিতির সভাপতি মো. সোলাইমান আকাশ বলেন, "ঝোপ-জঙ্গল আমাদের পরিবেশ রক্ষার একটি উপাদান। কিন্তু বাগানের লোকজন নিজেদের স্বার্থের লোভে তা নিধন করে যাচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।”
চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, "অবাধে রাবার বাগানে আগুন দেওয়া ফলে অসংখ্য ছোট ছোট কীট-পতঙ্গ এবং জীবজন্তু মারা যায়। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টের পাশাপাশি জমির উর্বরতাও কমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে।”
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানান, "এভাবে আগাছা পুড়িয়ে নিধনের কারণে মাটি, ফসল ও এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো কাজ করা ঠিক নয়। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা করা সবার দায়িত্ব।”
বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন চট্টগ্রাম জোনের মহাব্যবস্থাপক এ.এ.এম শাহজাহান সরকার বলেন, 'বাগানের প্রয়োজনে আমরা ঝরে পড়া পাতা ও জঙ্গলগুলো পুড়ে দিই।"
উল্লেখ্য, বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন চট্টগ্রাম জোনের আওতাধীন ৯ টি রাবার বাগানের মধ্যে চারটি রাবার বাগান রয়েছে ফটিকছড়িতে। সরকারী রাবার বাগানগুলো হলো- কাঞ্চন নগর, তারাঁখো, দাঁতমারা ও রাঙ্গামাটিয়া। যেসব বাগানের আয়তন প্রায় ১০ হাজার ৩শ' ৫৮ একর।