‘মুরগিকে পর্যাপ্ত খাবার না দিয়ে বিক্রি করে দিতো খামারে কর্মরত নৃ-গোষ্ঠীর শ্রমিকরা। এ নিয়ে প্রতিবাদ করেন পোল্ট্রি খামারের ম্যানেজার শিবলী সাদিক হৃদয় (১৯)। এ কারণে খামারে কর্মরত ওই শ্রমিকদের সঙ্গে কয়েক দফা বাগবিতণ্ডাও হয় তার। তখন থেকে শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নেয় হৃদয়কে উচিৎ শিক্ষা দেবে। আর উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে খামার থেকে অপহরণ করে চট্টগ্রামের রাউজান-রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী রঙিন পাহাড়ে নিয়ে যান। সেখানে গলা কেটে হত্যা করে লাশ কলা পাতা দিয়ে ডেকে দেয়। লাশ যাতে শনাক্ত না হয় এ জন্য ছুরি দিয়ে শরীর থেকে মাংস পৃথক করে ফেলে দেয়।’
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম রবিবার (১ অক্টোবর) সকালে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া যুবক উচিংথোয়াই মারমা ও তার অন্যতম সহযোগী ক্যাসাই অং চৌধুরীকে শনিবার গ্রেফতারের পর তারা র্যাবকে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে জানাতে র্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাহবুব আলম বলেন, ‘হৃদয়কে হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে উচিংথোয়াই মারমাকে শনিবার পতেঙ্গা থানা এলাকা থেকে ও তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাসাই অং চৌধুরীকে নতুন ব্রিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।’
‘হৃদয় তার পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করার জন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নে একটি পোল্ট্রি খামারে ম্যানেজারের কাজ করতো। একই খামারে ৫-৭ জন সহযোগী কর্মচারীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বাগবিতণ্ডা হয়। পরে এ বিষয়ে খামার মালিকরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলেও তার সহযোগীদের মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা থেকে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২৮ আগস্ট রাতে উমংচিং মারমার নেতৃত্বে হৃদয়কে অপহরণ করা হয়। ওই রাতেই ভুক্তভোগীকে দিয়ে তার বাবার কাছে কল করে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এক পর্যায়ে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হৃদয়ের অভিভাবকরা রাজি হন। পরে ১ সেপ্টেম্বর তার বাবা ও নানা মুক্তিপণের টাকা নিয়ে বান্দরবানে যান।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেখানে মুক্তিপণের দুই লাখ টাকা দেওয়ার পর অপহরণকারীরা জানায়, হৃদয় নিজে নিজে বাসায় চলে যাবে। মুক্তিপণ দেওয়ার পরও ৫-৬ দিনেও হৃদয় আর ফেরত না আসায় তার মা গত ৭ সেপ্টেম্বর রাউজান থানায় ছয় জনকে আসামি করে অপহরণ মামলা করেন। এরপর রাউজান থানা পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই জনকে গ্রেফতার করে। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। তারা আদালতে উমংচিং মারমার নেতৃত্বে শিবলীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয় বলে জানায়।’
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, ‘গ্রেফতার উচিংথোয়াই মারমা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, হৃদয়কে অপহরণের একদিন পর ২৯ আগস্ট বিকালে রঙিন পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে হত্যা করা হয়। উচিংথোয়াই মারমা নিজেই ছুরি দিয়ে হৃদয়ের গলা কাটে। তার সহযোগী ক্যাসাই অং চৌধুরীসহ আরও চারজন হৃদয়ের হাত-পা এবং মুখ চেপে ধরেন। হত্যায় তিনটি পার্ট ছিল। এর মধ্যে অপহরণ গ্রুপ, কিলিং গ্রুপ ও লাশ গুম গ্রুপ। অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল শুধুমাত্র যারা খামারে কাজ করতো। এর মধ্যে উমংচিং মারমা এবং অং থুই মারমা হৃদয়কে অপহরণের পরিকল্পনা করে। উচিংথোয়াই মারমা এবং তার অন্যতম সহযোগী ক্যাসাই অং চৌধুরীকে বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামে কাজ আছে বলে ডেকে আনে। তাদেরকে দিয়ে হৃদয়কে হত্যা করা হয়। এরপর মাথাসহ শরীর বিচ্ছিন্ন করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘হৃদয়কে হত্যার পর উচিংথোয়াই মারমার মোবাইল থেকে হৃদয়ের বাবা-মাকে ২৯ আগস্ট কল করে মুক্তিপণের টাকা বান্দরবানে নিয়ে আসতে বলে। ১ সেপ্টেম্বর বান্দরবানে গিয়ে হৃদয়ের পরিবার মুক্তিপণের টাকা দিয়ে আসে। এর মধ্যে উচিংথোয়াই মারমা নিজেই দেড় লাখ টাকা রেখে দেয়। বাকিদের ৫০ হাজার টাকা দেন।’
র্যাবকে লাশ গুমের বিষয়ে গ্রেফতার জানায়, পাহাড়ে হৃদয়কে হত্যার পর লাশ প্রথমে কলাপাতা দিয়ে ডেকে দেওয়া হয়। পরে লাশটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন শনাক্ত করতে না পারে এ জন্য টুকরো করা হয় এবং শরীরের মাংস আলাদা করা হয়। এ ঘটনার সঙ্গে সবমিলিয়ে ৯-১০ জন অংশ গ্রহণ করে। এর মধ্যে র্যাব দুই জন এবং রাউজান থানা পুলিশ আরও ছয় জনসহ মোট আট জনকে গ্রেফতার করে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলমান আছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে র্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, ‘হৃদয়কে হত্যার পর মাংস খেয়ে ফেলেছে এমন একটি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা বলেছে, এ ব্যাপারে তারা জানে না। তবে শরীরের মাংস আলাদা করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এটি সত্য। তবে মাংস খাওয়ার বিষয়ে কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।’
উল্লেখ্য, গত ১১ সেপ্টেম্বর সকালে রাউজান-রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের সীমান্তভর্তি রঙিন পাহাড় থেকে হৃদয়ের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। উমংচিং মারমা নামে গ্রেফতার এক অপহরণকারীর দেখানো মতে পাহাড়ি এলাকা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এদিকে লাশ নিয়ে ফেরার পথে পুলিশের কাছ থেকে ঘটনায় জড়িত আসামি উমংচিং মারমাকে ছিনিয়ে নেয়। পরে উত্তেজিত গ্রামবাসীর গণপিটুনিতে তার মৃত্যু হয়।