অজিত কুমার দাশ। সবাই যাঁকে সম্বোধন করেন ‘বাবু’ বলে। বিএসপি ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। বাড়ি বাঁশখালী হলেও চট্টগ্রাম শহরেই গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ। রয়েছে একাধিক বহুতল ভবন। ঘুরে বেড়ান বিলাসবহুল গাড়িতে।
লোকমুখে দানবীর হিসেবে পরিচিত পেতে ডোনেশনও করেন তিনি। অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোয় হিন্দু নেতা হিসেবেও তাঁর বেশ পরিচিতি আছে। কিন্তু দানবীরের আড়ালেই এই হিন্দু নেতা চালাচ্ছেন ভেজাল ঘি’র রমরমা বাণিজ্য। একের পর এক বিএসপি ফুডে ভেজাল ধরা পড়লেও প্রতিবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান বিএসপি ফুডের মালিক অজিত দাশ। তার বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি ও বিএসটিআইয়ে‘র লগু ব্যাবহারের অভিযোগও রয়েছে।
কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকায় বড়সড় কারখানা রয়েছে বিএসপি ফুড প্রোডাক্টের। ওই কারখানায় কুকমি ঘি ছাড়াও বানানো হচ্ছে কুকমি গার্লিক টোস্ট বিস্কুট, ডরিমন বিস্কুট, কুকমি স্পেশাল টোস্ট বিস্কুট, মিল্ক কোকোনাট বিস্কুট, বিএসপি টোস্ট, বিএসপি পটেটো ক্রেকার্স, বিএসপি ড্রাই কেক, সয়া সস্, হট টমেটো সস্, বিএসবি মিস্টার টুইস্ট, বিএসবি চিকেন চিপস, কমপ্লান, নাটি মিল্ক বিস্কুট, কোকমি হরলিক্স, বিএসপি পেনাট, বিএসপি চানাচুর, ভিনেগার, বিএসপি ঘি, চকলেটসহ হাজারো ভোগ্যপণ্য।
দীর্ঘদিন ধরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিষাক্ত কাঁচামালে ভেজাল ভোগ্যপণ্য উৎপাদন এবং বিএসটিআইয়ের গুণগতমান পরীক্ষা না করে পণ্য বাজারজাত করছে বিএসপি ফুড। এ কারণে তাদের জরিমানাও গুণতে হয়েছে বহুবার।
এরমধ্যে ২০১২ সালে তাদের জরিমানা গুণতে হয় ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা, ২০২০ সালে ২১ লাখ টাকা, একই বছরে আরেক অভিযানে আরও ১ লাখ টাকা।
২০২২ সালের শুরুতে দুটি মামলাসহ গুণতে হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা। বিএসপি ফুডস প্রোডাক্টস কোম্পানি একের পর এক জরিমানা গোনার পরও নিজেদের বদলাতে পারেনি।
বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস কারখানা থেকে আবারও ভেজাল ঘি জব্দ করা হয়।অভিযানে ৩ হাজার ৩৬০ কেজি ভেজাল ঘি’র পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ নিম্নমানের বিষাক্ত ফ্লেভার, পাম ওয়েল, ডালডা উদ্ধারসহ কারখানাটির জেনারেল ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম নিজামকে আটক করা হয়।
নগরের চান্দগাঁও থানাধীন কালুরঘাট বিসিক শিল্প নগরীর বিএসপি ফুড প্রোডাক্টসে এ অভিযান পরিচালনা করে র্যাব ৭।র্যাব-৭ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. নুরুল আবছার বলেন, চান্দগাঁওয়ের বিএসপি ফুডস প্রোডাক্টস প্রতিষ্ঠানের ভেতর ভেজাল ও নিম্নমানের বিষাক্ত ফ্লেভার, পাম ওয়েল ও ডালডা মিশিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ঘি তৈরি করা হয়। বিক্রির জন্য রাখা এ ঘি’তে দুধের কোনো উপাদানই নেই। গোপনে খবর পেয়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ঘি জব্দ করা হয়েছে।
আটক আমিনুল ইসলাম নিজামের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তাঁকে চান্দগাঁও থানায় পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে অভিযোগের ব্যাপারে জানতে বিএসপি ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজিত কুমার দাশের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় দিতেই ‘এখন ব্যস্ত আছি’ বলে তিনি তিনি ফোন কেটে দেন।
এদিকে বিএসপি ফুড প্রোডাক্টস (প্রা.) লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট (মূসক) ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের বিসিক শিল্পনগরী এলাকার খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট পরিশোধ ছাড়াই পণ্য বাজারজাত করে আসছে। গত পাঁচ বছরে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ছয় কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, চট্টগ্রাম
সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলার পর কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক অজিত কুমার দাশ। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে উৎপাদিত বিস্কুটের প্যাকেটে অবৈধভাবে বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করায় মামলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, বিএসপি ফুড ভ্যাট-নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরও মূসক চালান (মূসক-১১) ছাড়াই পণ্য বাজারজাত করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদিত পণ্য ও বিক্রয় ক্রয়-বিক্রয় হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয় না। জেনেশুনে প্রতিষ্ঠানটি এভাবে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে। আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটির পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহÑএ দুই পর্যায়ে ভ্যাট প্রযোজ্য। বিস্কুট, আচার, চাটনি ও টমেটো ক্যাচাপ বা সসের ওপর ট্যারিফ মূল্যভিত্তি ও অন্যান্য পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য। ট্যারিফ মূল্য পণ্যের সঠিক ভ্যাটের পরিমাণ হিসাব করার ক্ষেত্রে প্রতি অর্থবছরের সুনির্দিষ্ট এসআরও অনুযায়ী পণ্যের মূল্য হিসাব করা হয়। এছাড়া অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দ করা কম্পিউটার থেকে প্রাপ্ত বিক্রয়মূল্যকে পণ্য বা ভ্যাটসহ মূল্য বিবেচনায় নিয়ে ভ্যাট ফাঁকি হিসাব করা হয়।
প্রতিষ্ঠানের ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট ফাঁকি হিসাব করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মোট প্রায় ১১ কোটি ৬৩ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। এর মধ্যে ট্যারিফভুক্ত পণ্যের বিক্রয়মূল্য প্রায় তিন কোটি ২৭ লাখ টাকা। ট্যারিফভুক্ত পণ্যের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট প্রায় ২৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা। ১৫ শতাংশ হারে (আদর্শ হার) পণ্যের বিক্রয়মূল্য প্রায় আট কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর ওপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট প্রায় এক কোটি ৯ লাখ টাকা। এতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট ভ্যাট ফাঁকি এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মোট ভ্যাট ফাঁকি এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ফাঁকি এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফাঁকি এক কোটি দুই লাখ টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ফাঁকি এক কোটি সাত লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ কোটি ৮০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা পরিশোধ না করে ফাঁকি দিয়েছে।
ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটে দুই শতাংশ হারে সুদ প্রায় ১১ লাখ ৬১ হাজার টাকা। এ ভ্যাট পরিশোধে গত ১২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দিয়ে দাবিনামা-সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ভ্যাট ফাঁকির অপর একটি মামলা হচ্ছে বলে ভ্যাট কমিশনারেট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরেই অজিত দাশের রয়েছে একাধিক বহুতল ভবন। খাতুনগঞ্জের চাক্তাইয়ে একটি বাণিজ্যিক ভবন ছাড়াও চেরাগীপাহাড়, জামালখান এবং বেটারিগলিতেও রয়েছে আবাসিক ভবন।
ব্যবসায়িক থেকে ধর্মীয়— অসংখ্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত অজিত দাশ। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন-চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি, বিসিএসআইআর বাংলাদেশ লিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, হিন্দু হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হিন্দু মহাজোটের প্রধান পরামর্শক।
এছাড়া একই পদে (প্রধান পরামর্শক) আরও চারটি সংগঠনে রয়েছে তাঁর নাম। সংগঠনগুলো হলো— চট্টগ্রাম সায়েন্স ফাউন্ডেশন, চিটাগাং কণ্ঠ, এনভায়রনমেন্ট ফোরাম, বিজয় বাংলাদেশ। ডুলেন্স প্রাক্তন সৈনিক কল্যাণ সমিতি (দেসওয়া) ট্রাস্টে ‘প্রধান’ শব্দটি বাদ দিয়ে যুক্ত হন পরামর্শক পদে।
এছাড়া অজিত কুমার দাশের নাম রয়েছে কালুরঘাট বিসিক মালিক সমিতিতে। এই সমিতিতে তাঁর পদ জয়েন সেক্রেটারি। সদস্য পদ রয়েছে ইউনেস্কো ক্লাব, সমাজসেবা অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম সিনিয়রস ক্লাব লিমিটেড, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, চট্টগ্রাম হাসপাতাল (রোগী কল্যাণ পরিবেশ), চট্টগ্রাম রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রমনা কালী মন্দির ও শ্রীমা আনন্দময়ী আশ্রম পরিচালনা পরিষদে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ সহসম্পাদক পদেও রয়েছেন তিনি।