আজ বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
এসআই ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতি জটিলতা : ১৫ বছরে ক্যাডার পদে ৪ বার পদোন্নতি হলেও নন-ক্যাডাররা পায় না একটিও

বিসিএস পুলিশে ক্যাডার-ননক্যাডার বৈষম্য

Author Thedaily Shangu | প্রকাশের সময় : সোমবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:১৮:০০ অপরাহ্ন | অন্যান্য

বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি চলছে অনেকটাই স্বাভাবিক নিয়মে। কিন্তু সরাসরি মাঠ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা পুলিশের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা বা সদস্যদের যথাসময়ে হচ্ছে না পদোন্নতি। এ নিয়ে প্রতিনিয়তই মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের সৃষ্টি হচ্ছে বিসিএস পুলিশ ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের মধ্যে। দীর্ঘদিনেও পদোন্নতি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা। 

 

তাদের দাবি, সরকার পদোন্নতি জটিলতা নিরসনে পুলিশ সুপার (এসপি) ও উপ-মহাপরিদর্শকদের (ডিআইজি) জন্য সুপার নিউমারি পদের ব্যবস্থা করছে, কিন্তু সেখানে সেই সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছেন ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) ও সাব-ইন্সপেক্টর বা সার্জেন্টরা। 

 

 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমাণ। পদ খালি থাকলেও তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। আবার কোনোমতে এসআই থেকে ইন্সপেক্টর পদোন্নতি হলেও তার উপরের ধাপ তথা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে আর সেভাবে পদোন্নতি হচ্ছে না। বলতে গেলে এই পুলিশ ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি যেন এখন বড় জটিলতায় আটকে আছে। চাকরির বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও ভাগ্যে মিলছে না পদোন্নতি। অনেকে যে পদে চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন, সেই পদেই অবসরে চলে যাচ্ছেন। এর ফলে পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের মধ্যে পারস্পরিক ক্ষোভ বাড়ছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

 

এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, পরিদর্শক পদ জটিলতা নিরসনের জন্য সরকার চাইলে পদ সৃষ্টি করে পরিদর্শকদের জন্য পদোন্নতির ব্যবস্থা করতে পারেন। তিনি বলেন, আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন বিভিন্ন পলিসির মাধ্যমে নতুন পদ সৃষ্টি করে অনেকটা পদোন্নতি নিরসন করেছি।

 

এখনও সরকার চাইলে ক্যাডারদের মতো নন-ক্যাডারদের সুবিধা দিতে পারে। যেমন সুপার নিউমারিতেও অপেক্ষমাণ পরিদর্শকদের পদোন্নতির আওতায় আনতে পারে। তিনি আরও বলেন, সামনে নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশের বিসিএস ক্যাডারে বিভিন্ন পদে পদোন্নতি হয়েছে। এখানে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের বিষয়টিও মাথায় রাখা উচিত। কারণ তারাও নির্বাচনের মাঠে কাজ করবেন। 

 

 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক পরিদর্শক মাজহারুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, সম্প্রতি আমরা আইজি স্যারকে জানিয়েছি, যেন আমার দিকটাও তারা দেখেন। পুলিশ ক্যাডার থেকে ১৫ বছরে তারা চারটি পদোন্নতি নিচ্ছেন। আমাদের চাকরির মেয়াদ ৩০ বছর। এসআই পদেই ১৫ বছর পেরিয়ে যায়। এরপর পরিদর্শক পদ থেকে ২৫ বছর পেরিয়ে গেলেও একটি পদোন্নতি হয় না। অথচ ১৫শ’র বেশি পরিদর্শক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে প্রমোশন লিস্টে (পিএল) থাকলেও সেখান থেকে বেরোতে পারছেন না। তিনি বলেন, সম্প্রতি পদ নিরসনের জন্য সুপার নিউমারির ব্যবস্থা করেছেন। আমাদেরও যেন কোটা অনুযায়ী পদোন্নতি দেওয়া হয়। আমাদের বেলায় যেন পদ বৈষম্য না হয় এটাই অনুরোধ।

 

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সময়ের আলোকে বলেন, পুলিশের নন-ক্যাডার কোনো পদ নেই। পুলিশ ক্যাডারে যারা পদোন্নতি পাচ্ছেন তারা নিয়মের মধ্যেই পাচ্ছেন। আমরা কাউকেই খাটো করে দেখছি না।

 

সুপার নিউমারির বিষয়ে তিনি বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এটা এখনও প্রসেসিংয়ের মধ্যে আছে। তাছাড়া পরিদর্শকরা এটা নিয়ে কোনো আবেদনও করেননি। তারা আবেদন করলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতিতে এসআই ও পরিদর্শকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আসলে এই অভিযোগ সঠিক না। এসআই ও পরিদর্শকরা যে নিয়মে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন তাদের সেভাবেই পদোন্নতি দেওয়া হয়। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আমরা বসে সমস্যা থাকলে নিরসন করা হবে।

 

 

পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা নবম গ্রেডের কর্মকর্তা। সরকারি অন্য চাকরিজীবীরা এই গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেলে তাদের গ্রেড পরিবর্তন হয়ে ষষ্ঠ হয়, অথচ আমাদের এএসপি পদে পদোন্নতি হলে গ্রেডের কোনো পরিবর্তন হয় না। কারণ এএসপিরাও নবম গ্রেডের কর্মকর্তা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, কোনো কর্মকর্তা একই পদে ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময় কর্মরত থাকলে তার গ্রেড পরিবর্তন হয়। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে সাধারণত তা হয় না। গ্রেড পরিবর্তন করতে হলে আবেদনের পাশাপাশি ব্যাপক তদবির করতে হয়। তারা জানান, পরিদর্শক থেকে এএসপি হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তাদের জন্য ৩৩ ভাগ কোটা থাকলেও গত তিন বছরে মাত্র ৩০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ অমানবিক। তারা বলেন, প্রত্যেক সার্কুলারে সরাসরি এএসপি পদে ২০০-২৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরিদর্শক থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি হয় ১ থেকে ২ শতাংশ।

 

বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, সম্প্রতি পুলিশ প্রধানের সঙ্গে বিশেষ কল্যাণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রস্তাব করা হয় পরিদর্শকরা নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পাওয়ার পরও নবম গ্রেডে থেকে যাচ্ছেন। অথচ বিধি অনুযায়ী পদোন্নতির পর তাদের ষষ্ঠ গ্রেডে যাওয়ার কথা। তখন আইজিপি আশ^স্ত করেন পুলিশ সদর দফতরে অবেদন করতে। পরে ব্যবস্থা নেবেন।

 

আইজিপির কাছে দেওয়া আবেদনে বিষয়ে পরিদর্শকরা বলেন, পুলিশ পরিদর্শক ছিল দ্বিতীয় শ্রেণির পদ। ২০১২ সালে সরকার এটিকে প্রথম শ্রেণির নন-ক্যাডার পদে উন্নীত করে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কর্মরত নন-ক্যাডার (নবম গ্রেড) কর্মকর্তারা ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে নবম গ্রেডের কর্মকর্তারা পদোন্নতির পরও নবম গ্রেডে থেকে যায়। যেমন ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়রি ৩৫ পুলিশ পরিদর্শকের পদোন্নতির আবেদনে প্রজ্ঞাপন সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন তুলে ধরা হয়। বলা হয়, পুলিশ পরিদর্শকদের নবম গ্রেড থেকে পদোন্নতি দেওয়ার পর নবম গ্রেডে থেকে যাওয়ায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আর এতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নন-ক্যাডার কর্মকর্তার তুলনায় পুলিশ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

 

 

পরিদর্শকরা জানান, এএসপি হিসেবে পদোন্নতি ৩৩ শতাংশ দেওয়ার কথা থাকলেও বিগত ৩ বছরে ৩০ জনের মতো এএসপি হয়েছেন পরিদর্শকরা। পক্ষান্তরে বিসিএস ক্যাডার নেওয়া হয়েছে বিগত ৩ বিসিএসএ ৫০০ জনের মতো। এএসপি থেকে ২৮৮ পদ নিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে ডিআআইজি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ক্যাডার যারা তারা পাচ্ছেন কিন্তু পরিদর্শক থেকে এএসপি হচ্ছেন না। যার কারণে এসআই থেকে পরিদর্শক হিসেবে পদোন্নতি হচ্ছে না।

 

তারা বলছেন, সুপার নিউমারি শুধু এসপি ডিআইজিদের কেন? এসআই থেকে পরিদর্শকদের দিতে সমস্যা কোথায়। একই দায়িত্ব পালন করলেও বেতন-স্কেলে পরিবর্তন হয় না আবার অতিরিক্ত অর্থও লাগে না।

 

এ প্রসঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সময়ের আলোকে বলেন, আমরা নিচের পদে পদোন্নতির জন্য পুলিশ সদর দফতরে কয়েক বার সভা করেছি। আশা করছি এই বিষয়গুলো শিগগিরই সমাধান করা হবে।