বর্ষা মৌসুমের প্রথম টানা ভারীবর্ষণে কক্সবাজারের চকরিয়ায় উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকাসহ অন্তত শতাধিক গ্রাম নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়ে পানিতে তলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুরু হওয়া টানা ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নিচের দিকে নেমে আসায় শনিবার রাতের দিকে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদ সামীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো.শাহ আরমান সালমান।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার কারণে উজানে লামা-আলীকদমের পাহাড় থেকে পানি নিচের দিকে নেমে আসায় শনিবার রাত ১টার দিকে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমা ৬ দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার অতিক্রম ৭ দশমিক ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবোর এই কর্মকর্তা বলেন, চলমান ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে রবিবার থেকে চকরিয়া উপজেলার বিশেষ করে উপকুলীয় অঞ্চলের অবস্থা আরো নাজুক হতে পারে। মাতামুহুরী নদীতে পানি প্রবাহ বাড়লেও রবিবার বিকাল পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন চকরিয়া উপজেলার ৬৫ পোল্ডার এবং শাখা পোল্ডার গুলোর বেড়িবাঁধের কোন ধরণের ভাঙ্গন কিংবা ক্ষতিসাধনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বৃষ্টিপাত থাকলে পানি আরও বাড়বে, তাতে বেড়িবাঁধের চরম ক্ষতিসাধন হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দাবি করেছেন, প্রতিবছর বর্ষাকালে ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢল নামে। ওইসময় উপজেলার বেশিরভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেলেও একদিনের মধ্যে নীচের দিকে নেমে সাগরে মিলিত হয়ে যায় পানি প্রবাহ। তাতে জনগনের দুর্ভোগের মাত্রা অনেকাংশে কমে যায়। তবে এবছর জনগনের জন্য বিষপোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে বাস্তবায়িত দোহাজারী-কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত চকরিয়া অংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটি। কারণ বর্ষণের শুরুতে এই রাস্তার পূর্বাংশজুড়ে আটকা পড়েছে কয়েকফুট উচ্চতায় বৃষ্টির পানি। পানি নেমে যাওয়ার জন্য এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট কালভার্ট না থাকায় এই পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। পানিতে তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর জমির রোপিত ফসল। এক্ষেত্রে রেল লাইনের উুঁচ রাস্তাকেই প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখছেন ভুক্তভোগী মানুষগুলো। অপরদিকে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিত হতে চলেছেন এখানকার কৃষকেরা। নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে প্লাবিত হওয়ায় ধানের বীচতলা ও সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সরেজমিন ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে বর্ষণের শুরুতে মাতামুহুরী নদীর তীরের জনপদ সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, সাহারবিল, চিরিংগা, কৈয়ারবিল ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের নিন্মাঞ্চল হাটু সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
অপরদিকে, উপজেলার পশ্চিমাংশের রেল লাইনের উঁচু রাস্তাটির কারণে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে হারবাং, বরইতলী, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পূর্ববড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, বিএমচর, সাহারবিল, চিরিঙ্গা, ফাঁসিয়াখালী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। তার ওপর ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ফসলও।
স্থানীয় জনপ্রতনিধিরা জানিয়েছেন লাগাতার বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে উপজেলার চিংড়ি জোনের মৎস্য প্রকল্পসমূহ পানিতে তলিয়ে গিয়ে বিপুল পরিমাণ মাছ পানিতে ভেসে যাওয়ার আশংকা দেখা যাচ্ছে।
বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান ছালেকুজ্জামান বলেন, ভারী বর্ষণে
আমার এলাকায় বেশিভাগ নিম্মাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোও পানিতে ডুবে গেছে। রবিবার বিকাল থেকে বাঘগুজারা রাবার ড্যাম এলাকার কয়েকটি গ্রামে নদীর পানি ঢুকেছে। এ অবস্থায় বেড়িঁবাধ ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার নীচু এলাকায় অন্তত শতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কাছে জিন্মি হয়ে পড়ে। আটকে থাকা পানি যাতে দ্রুত নেমে যায় সেজন্য আগে থেকে ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি ইতিমধ্যে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এভাবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে যেকোন সময় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে যেতে পারে। এতে পৌরশহর হুমকীর মুখে পড়তে পারে ।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম ও কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন বলেন, আমাদের ইউনিয়ন দুটি একেবারে মাতামুহুরী নদী লাগোয়া। নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এলাকার বিভিন্ন রাস্তা-ঘাট, ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লোকজন। রবিবার দুপুর থেকে অনেক পরিবারের ঘরে পানি ঢুকে পড়ার কারণে রান্নার কাজ বন্ধ রয়েছে ।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাধিক ফোরামের সভাপতি এম আর মাহমুদ জানান, উপজেলার চারিদিকে বিভিন্ন ধরণের উঁচু রাস্তা ও বাঁধ থাকায় ভারী বর্ষণ ও নদীর পানি ভাটির দিকে নামতে পারছে না। এতে ডুবে যাচ্ছে লোকালয়। এই অবস্থায় বিপদসীমা অতিক্রম করে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানিও নামতে শুরু করেছে মাতামুহুরী নদীতে। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখিন হবেন চকরিয়ার মানুষ।
মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ভারী বর্ষণে কারণে ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। কারণ দোহাজারি টু কক্সবাজার এবং ফাঁসিয়াখালী টু মাতারবাড়ি কয়লাবিদ্যুত পর্যন্ত রেললাইন সড়কের বিশাল অংশ আমার ইউনিয়নে পড়েছে। এতে বৃষ্টির পানি নামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করছে রেল লাইনের উঁচু রাস্তা। তাই রেল লাইনটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগে এলাকাভিত্তিক সমস্যা চিহ্নিত করে পানি যাতে ভাটির দিকে নামতে পারে সেজন্য ছোট ছোট কালভার্ট নির্মাণ করা খুবই জরুরী। এসব বিষয় জেলা এবং উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অবহিত করা হবে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, টানা ভারি বর্ষণ এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি যাতে দ্রুত ভাটির দিকে নেমে যেতে পারে সেজন্য উপকূলীয় এলাকার সকল স্লুইস গেট গুলো জরুরী ভিত্তিতে খুলে দিতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, রবিবার বিকালে আমি বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে পানি নামতে যেসব পয়েন্টে প্রতিবন্ধকতা আছে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রেল লাইনের উঁচু রাস্তার কারণে যেসব এলাকায় পানি নামতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে তা চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে তিনি জানান।