আজ রবিবার ১৯ মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দামে টালমাটাল দেশের আবাসনখাত

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : বুধবার ২৩ মার্চ ২০২২ ০৪:১১:০০ অপরাহ্ন | দেশ প্রান্তর

গত দুই বছরে দেশের আবাসনখাতের ওপর দিয়ে গেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বড় ধাক্কা। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত ও শিক্ষা কার্যক্রমের মতো এ খাতেও নেমেছিল স্থবিরতা। দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ ছিল বহু প্রকল্পের নির্মাণকাজ। একটা সময় করোনার প্রভাব সামলে ধীরে ধীরে চাঙা হতে শুরু করে আবাসন শিল্প। রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) আয়োজনে আবাসন মেলায় অর্ডার আসে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এতে স্বস্তি ফেরে খাতসংশ্লিষ্ট প্রায় ২৬৯টি লিংকেজ কোম্পানিতে। তবে এই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গত কয়েক মাসে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ফের গভীর সংকটে পড়েছে এ খাত।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের শুরু থেকে বাড়ছিল নির্মাণসামগ্রীর দাম। এ বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে সেই দাম বাড়ার পালে হাওয়া দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। এমনকি সম্প্রতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে রড, সিমেন্ট ও টাইলসের মতো নির্মাণসামগ্রীর দাম। এর প্রভাবে কমছে নতুন ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ, হস্তান্তর ও বিক্রি।

নির্মাণশিল্পের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম এ যাবতকালের সব রেকর্ড ভেঙেছে। গত দুই সপ্তাহে প্রতি টন রডে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে। খুচরা বাজারে এক টন রডের দাম ছাড়িয়েছে ৯০ হাজার টাকা। রেকর্ড দাম ছুঁয়েছে সিমেন্ট। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে দামে চোখ রাঙাচ্ছে ইট, খোয়া আর বালিও।

নতুন ভবন নির্মাণে কাঁচামালের দামে ঊর্ধ্বমুখী ধারায় গতি হারিয়েছে নির্মাণকাজ। রড-সিমেন্টের আকাশছোঁয়া দামের প্রভাবে বহু প্রকল্পের কাজ প্রায় অর্ধেকে নেমেছে বলে জানান নির্মাণশিল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের শঙ্কা, লাফিয়ে লাফিয়ে নির্মাণ খরচ বাড়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যয় বেড়েছে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ারফিটে ন্যূনতম চার থেকে পাঁচশ টাকা বাড়তে পারে। পাশাপাশি আবাসনের সঙ্গে জড়িত ২৬৯টি খাতের প্রায় ৩৫ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান নিয়েও বাড়ছে অনিশ্চয়তা।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি কোনো প্রভাব না পড়লেও নিত্যপণ্যের দামের পাশাপাশি দেশের বাজারে রাতারাতি বাড়তে শুরু করে নির্মাণসামগ্রীর দাম। এতে দ্রুত স্থবিরতা নামে প্রকৌশল, স্থাপত্য, সিমেন্ট শিল্প, রি-রোলিং মিলস, ইটভাটা, বালু, টাইলস-সিরামিক, পাথর, পরিবহন, পাইপ, ফিটিংস, ক্যাবলস, কাচ ও অ্যালুমিনিয়াম ফিটিংসসহ বিভিন্ন খাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

ইতিহাসের রেকর্ড দামে রড

দেশে প্রথমবারের মতো প্রতি টন রডের দাম ছাড়িয়েছে ৯০ হাজার টাকা। বর্তমানে বিএসআরএম’র ৬০ গ্রেড এক টন রড বিক্রি হচ্ছে ৯০ হাজার ৫০০ থেকে ৯১ হাজার টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৮৮ হাজার টাকা। মাসখানেক আগে এ দাম ছিল ৭৫ থেকে ৭৮ হাজার টাকা। বাজারে প্রতি টন একেএস রড ৮৮ থেকে ৮৯ হাজার টাকা, কেএসআরএম ৮৭ থেকে ৮৮ হাজার, জিপিএইচ ৮৭ থেকে ৮৮ হাজার, বন্দর ৮৮ হাজার ৫০০ থেকে ৮৯ হাজার এবং কেএসএমএল প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৮৭ থেকে ৮৮ হাজার টাকায়। পাশাপাশি আনোয়ার, রহিমসহ কয়েকটি কোম্পানির রড পাওয়া যাচ্ছে ৮৬ থেকে ৮৭ হাজার টাকায়।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির কাঁচামালের দাম বাড়ার অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে রড, মোটা-পাতলা প্লেনশিট ও অ্যাঙ্গেলের দাম। সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, রডের ক্রয়াদেশ থাকলেও সময়মতো সরবরাহ নেই। বিশ্ববাজারে সরবরাহ সংকটের কারণেই দেশেও নির্মাণসামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী।

রডের বর্তমান বাজারদর নিয়ে কথা হয় পুরান ঢাকার নওয়াব ইউসুফ রোডের মেসার্স ভাণ্ডার ট্রেডার্সের ব্যবস্থাপক মো. শরিফের সঙ্গে। দুই কোম্পানির ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করা মো. শরিফ বলেন, একদিকে রডের দাম বেড়েছে, অন্যদিকে ঠিকমতো রড পাওয়া যাচ্ছে না। আগে কোম্পানি থেকে অর্ডার দিলে যে রড দু-একদিনের মধ্যে পেতাম, এখন তা পেতে ১০-১৫ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে। ফলে চাহিদামতো রডের জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে ভবন নির্মাণের অন্যতম এ উপকরণটির দাম বাড়ছে। দাম বাড়ায় বিক্রিও কমেছে। আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে চলমান অনেক নির্মাণকাজ বন্ধ রেখেছেন। নির্মাণসামগ্রীর অস্থিতিশীল বাজারে নতুন করে কাজ শুরুর সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। এ পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোতে কী হবে বলা মুশকিল।

রেকর্ড দামে সিমেন্ট

দেশের নির্মাণশিল্পের আরেক অন্যতম উপকরণ সিমেন্ট উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার, লাইমস্টোন, স্ল্যাগ, ফ্লাই অ্যাশ ও জিপসাম আমদানিনির্ভর। এগুলোর মধ্যে ৬২ থেকে ৯০ শতাংশই ক্লিংকার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি টন ক্লিংকারের দাম ৬০ ডলার থেকে বেড়ে ৭৫-৭৯ ডলারে উঠেছে। সিমেন্ট উৎপাদনের অন্যান্য কাঁচামালের দামও টনপ্রতি গড়ে ১০ থেকে ১২ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া কয়লা ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচামাল আমদানিতে জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়াও সিমেন্টের দাম বাড়ার বড় কারণ।

বর্তমানে দেশের বাজারে প্রায় সব কোম্পানির সিমেন্টে বস্তাপ্রতি ৩০-৬০ টাকা বেড়েছে। ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ টাকার সিমেন্ট প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৪৬০ থেকে ৫০০ টাকায়। রাজধানীর বিভিন্ন সিমেন্টের বাজারে শাহ স্পেশাল ৪২০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬০-৪৭০ টাকা, সুপারক্রিট ৪২০ থেকে বেড়ে ৪৭০-৪৭৫, স্ক্যান সিমেন্ট ৪৫০ থেকে বেড়ে ৪৮০-৪৮৫, বেঙ্গল সিমেন্ট ৪১০ থেকে বেড়ে ৪৬০-৪৭০ এবং মীর ৪০৫ থেকে বেড়ে ৪৫০-৪৫৫ টাকা বস্তা বিক্রি হচ্ছে। দোকানিদের আশঙ্কা, আগামী দিনে দাম আরও বেড়ে বস্তাপ্রতি ৫০০ টাকা ছাড়াতে পারে।

সিমেন্টের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের কোম্পানি সচিব কাজী মো. শফিকুর রহমান বলেন, দেখতে দেখতে এ নির্মাণ উপকরণটির কাঁচামালের দাম অনেক বেড়েছে। ফলে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। কাঁচামালের দামের এ ঊর্ধ্বগতি আগামী দিনগুলোতে সিমেন্টের দাম আরও বাড়িতে দিতে পারে।

অস্বাভাবিক দাম বিল্ডিং মেটেরিয়ালের

মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে বিল্ডিং মেটেরিয়ালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এক্ষেত্রে পাইকারির চেয়ে খুচরা বাজারে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে বাজারে আমদানি করা বিব কক ৮৬৮ থেকে বেড়ে ১১০০ টাকা, সিং কক ৯৪০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০, টু ইন ওয়ান ১ হাজার ৫৬৫ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৮২০, পিলার কক ১ হাজার ২০৮ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৫০০, মুভিং সিং কক ১ হাজার ৩৩৮ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬৫০, অ্যাঙ্গেল টপ কক ৫৬৬ থেকে বেড়ে ৭৩০, লিভার পিলার কক ১ হাজার ১১৬ থেকে বেড়ে ১ হাজার ২৭০, মুভিং শাওয়ার হেড ১ হাজার ১৯০ থেকে বেড়ে ১ হাজার ৬৯৫, বেসিং মিক্সার ২ হাজার ৭৯৬ থেকে বেড়ে ২ হাজার ৯৩৫, ডাবল বোল সিং ২ হাজার ৯০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ২০০ ও গিজার ৮ হাজার ১০০ থেকে বেড়ে ৯ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কমোডের দাম বেড়েছে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। একইসঙ্গে অন্যান্য উপকরণের দামও বেড়েছে ১০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রাজধানীর পুরান ঢাকার আপন স্যানিটারির হিসাব মহাব্যবস্থাপক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মালামাল সরবরাহ অনেক কমে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এসব নির্মাণপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কিছু দেশ থেকে অর্ডার করা নির্মাণসামগ্রী এলেও জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন ভাড়া বাড়ার কারণে আমদানি খরচ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এসব কারণে দেশের বাজারও চড়া। আমদানিনির্ভর দেশগুলোতে পণ্যের দামের এ ঊর্ধ্বমুখী ধারা সহসা কমার সম্ভাবনা কম।

আগামী দিনে দেশের আবাসন শিল্পের ওপর বৈশ্বিক প্রভাব কতটা পড়তে পারে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদ বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ছেই। ঊর্ধ্বমূল্যের এ ধারায় অনেকটা থমকে গেছে বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণকাজ। প্রকল্প ব্যয় বাড়লে ক্রেতার ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এতে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম প্রতি স্কয়ারফুটে কয়েকশো টাকা বেড়ে যেতে পারে। একইসঙ্গে আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৬৯টি লিংকেজ কোম্পানির প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিয়েও অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের একটি তথ্য বলছে, প্রতি বছর দেশে ২২ হাজার ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়। এর ব্যত্যয় ঘটেছিল শুধু ২০২০ সালে। ওই সময় করোনাভাইরাসের মহামারিতে আবাসনেও মন্দা লেগেছিল। অন্যদিকে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি না হওয়ায় কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের টাকাও আটকে গেছে। এতে সংকটে পড়েছে কোম্পানিগুলো। হিসাব বলছে, গত এক মাসে গড়ে ১ হাজার ৮০০ ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। মূলত ক্রেতার দেখা না মেলায় এসব ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট অবিক্রীত। দাম কমে এলে আবার বিক্রি হবে এমনটা আশা খাত সংশ্লিষ্টদের।

ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়াসহ দেশের আবাসনখাতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, জিডিপিতে পুরো নির্মাণখাতের অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ। চলতি বাজারমূল্যে জিডিপিতে এ খাতের অবদান এক দশকে চার গুণের বেশি বেড়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে আবাসন খাতের সম্পর্ক কতটা প্রকট তা অর্থনীতিবিদরা খুব সহজেই হিসাব করতে পারবেন। সংশ্লিষ্ট লিংকেজ শিল্পসহ পুরো নির্মাণখাত বিবেচনায় আনলে জিডিপিতে এর অবদান দাঁড়াবে ২০ শতাংশের ওপর।

‘সরকারের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান, রড, সিমেন্ট, টাইলসসহ ২৬৯টি লিংকেজ কোম্পানি শিল্প প্রসারের মাধ্যমে গোটা নির্মাণখাত জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। দেশের আবাসন শিল্প শুধু আবাসনই সরবরাহ করছে। সাম্প্রতিক নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বমূল্যের কারণে দেশের ৪০ লাখ শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল আড়াই কোটি মানুষের ভাত-কাপড়ের জোগান দেওয়া আবাসন শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’