কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ও টিলাকে কেন্দ্র করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে হাজারো মানুষ। বর্ষা মৌসুম শুরু হলে এসব বসবাসকারীকে নিয়ে বাড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ভারী বৃষ্টিতে টিলা ধসে ক্ষয়ক্ষতি এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এ বসবাসকারীদের অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ হওয়ায় তারা টিলা বা পাহাড়ের পাদদেশের অল্প ভাড়ার ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে চায় না।
আবার কখনও প্রভাবশালীরা দখল টিকিয়ে রাখতে অনেককে পাহাড় বা টিলায় নিম্ন আয়ের মানুষকে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। মাঝেমধ্যে প্রশাসনের উচ্ছেদ কিংবা এসব মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রম মাইকিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
তবে সোমবার ভোর থেকে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিতে কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ে ঝুঁকি নিয়ে বসতিদের মাঝে ধসের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শুধু গত বছর অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ১২টি পাহাড়ে নির্মিত হয়েছে শতাধিক নতুন ঘর। আর সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে হাজারো মানুষ। ভারী বৃষ্টিতে এসব ঘর বিধ্বস্ত হয়ে নতুন করে প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বর্ষায় বাড়ে তোড়জোড়
সারা বছর নীরব থাকলেও বর্ষা এলেই প্রশাসন পাহাড়ের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে তোড়জোড় শুরু করে। টানা বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে কয়েকটি পাহাড়ে মাইকিং কার্যক্রমও শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন। রোডম্যাপ নির্ধারণ করে উচ্ছেদ অভিযানে নামার পরিকল্পনা করছে এ সংস্থা।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, টানা বর্ষণের ভূমি ধসের আশঙ্কায় উপজেলায় হ্নীলা, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও টেকনাফ পৌরসভার ৩২ পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বসতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় প্রায় সাত হাজার পরিবারের প্রায় অর্ধলাখের কাছাকাছি মানুষ বসতি করে আসছে।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হলো, ফকিরামুড়া, বৈদ্যোর ঘোনা, কুয়েত মসজিদ, পুরান পল্লান পাড়া, নাইট্যং পাড়া, বরইতলী, ঘুমতলী (বিজিবি ক্যাম্পের পেছনে), মরিচ্য গুনা, পশ্চিম সিকদার, মুরা পাড়া, লেচুয়াপ্রাং, ভিলেজার পাড়া, পশ্চিম রঙ্গীখালী, গাজী পাড়া, আলীখালী, লম্বাবিল, রইক্ষ্যং, করাচী পাড়া, কতুবদিয়া পাড়া, আমতলী, দৈংগাকাটা, হরিখোলা, কেরুনতী, বালুখালী, চাকমারকোল, কম্বিনিয়া পাড়া, শিয়াইল্যামুরা, সাতঘরিয়া পাড়া, হাছইন্নাটেক, শামলাপুর পুরান পাড়া, বড় ডেইল, মাথা ভাঙ্গা জাহাজপুরা, মারিষবুনিয়া, বাইন্যা পাড়া।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ‘টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরে যতে বলা হচ্ছে। এর জন্য আশ্রয়কেন্দ্রেগুলো খোলা রাখা হয়েছে। আমরা অতিঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের তালিকা তৈরি করছি। এরপর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। এ ছাড়া নিরাপদ স্থানে চলে যেতে প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে।’
স্থানীয়দের আশঙ্কা
জানা গেছে, পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ২০১০ সালের ১৪ জুন সকাল থেকে রাতভর টানা বর্ষণ স্থায়ী হয়ে ১৫ জুন ভোরে ভূকম্পন হলে বৃষ্টিপাতের মাত্রা প্রবল আকার ধারণ করে। এতে টেকনাফে ৩৩ জন এবং উখিয়ায় ২০১০ ও ১২ সালের টানা বর্ষণে হলদিয়া পালং, পালংখালী, জালিয়া পালং ও রত্নাপালং ইউনিয়নের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী লোকজনের বাড়ির দেয়াল ধসে ১৫ জন নারী-শিশু ও পুরুষ নিহত হয়েছিল।
সমস্যা দূর হচ্ছে না যেসব কারণে
অসহায় ও গরিব মানুষদের কাছ থেকে নামমাত্র টাকা নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি। প্রশাসন প্রতিবছর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধভাবে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা নির্ধারণ করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে এসব মূলহোতা ‘পাহাড়খেকোরা’।
কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলো নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না বলে এ সমস্যা দূর হচ্ছে না। প্রশাসন কখনও পাহাড়ে বসতি স্থাপনের মূলহোতাদের চিহ্নিত করেনি। যারা বসতি স্থাপন করেছে, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়নি।’
এ ব্যাপারে বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, ‘আমার এলাকার পাহাড়ে দেড় হাজার মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রবল বর্ষণে যাতে প্রাণহানি না ঘটে, এ জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মাইকিং করে তাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’