দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাবা ইমরান শরীফের বিরুদ্ধে জাপানি মা নাকানো এরিকোর করা আদালত অবমাননার অভিযোগ খারিজ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে আপিল বিভাগের আদেশ অমান্য করা নিয়ে জাপানি স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর পাল্টা অভিযোগ আমলে নেননি আদালত।
দুই শিশুকে নিয়ে জাপানি মা নাকানো এরিকোর করা আদালত অবমাননার অভিযোগ শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার (২ জুন) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। এদিন আদালতে জাপানি মায়ের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. আহসানুল করিম ও মুহাম্মদ শিশির মনির। অন্যদিকে বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আক্তার ইমাম। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।
এদিন সুপ্রিম কোর্টের একই বেঞ্চ দুই শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর করা আবেদন খারিজ করে দেন।
গত ১৭ মে দুই শিশুকে নিয়ে বিদেশে বেড়ানোর জন্য আদালতের অনুমতি নিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর আইনজীবী মুহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে ঢাকার পারিবারিক আদালতে করা মামলাটির (শিশুদের বাবার) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপান থেকে আসা দুই শিশু তাদের মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর হেফাজতে থাকবে বলে আদেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আর পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটি তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্ট আদালতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।
জাপান থেকে আসা দুই শিশু নিয়ে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে তাদের মা নাকানো এরিকো করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের ভার্চুয়াল আপিল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
এর আগে শিশুদের মায়ের করা আবেদনের ওপর ৭ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ১৩ ফেব্রুয়ারি আদেশের জন্য দিন রাখেন। তারই ধারাবাহিকতায় ওইদিন বিষয়টি আদেশ দেন আদালত।
দুই শিশুকে তাদের বাবার হেফাজতে আটক রাখা বে-আইনি ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের এর আগের আদেশের পর দুই শিশু কূটনৈতিকপাড়ায় অবস্থিত একটি আবাসিক হোটেলে তাদের মায়ের সঙ্গে আছে। এখন ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশুরা আগের মতোই মায়ের কাছে থাকবে বলে জানান মামলায় মায়ের পক্ষে থাকা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম।
ঘোষিত আদেশে আদালত বলেন, মামলার পারিপার্শ্বিকতা ও শিশুদের স্বার্থ বিবেচনায় শিশুদের এই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে (দেশের বাইরে) নেওয়া যাবে না। ঢাকার পারিবারিক আদালতে ২০২১ সালে করা মামলাটি (শিশুদের বাবার) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে।
আরও বলা হয়, আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে মামলাটি তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হলো। হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ বাতিল করা হলো। শিশুদের বাবা তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।
আদালতে ওইদিন শিশুদের বাবার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল, ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও ব্যারিস্টার অনীক আর হক। শিশুদের মায়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম ও মোহাম্মদ শিশির মনির।
জাপানের নাগরিক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরান শরীফের ২০০৮ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হয়। তাদের তিন মেয়ে রয়েছে। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন ইমরান। এরপর গত বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়ে জাপানে রয়েছে। তবে ইমরানের কাছ থেকে ১০ ও ১১ বছর বয়সী দুই মেয়েকে ফিরে পেতে ঢাকায় এসে গত ১৯ আগস্ট রিট করেন তার স্ত্রী নাকানো এরিকো। এতে দুই মেয়েকে বে-আইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, তা নিশ্চিতে তাদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চাওয়া হয়। অন্যদিকে, ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে আরেকটি রিট করেন ইমরান।
নাকানো এরিকো ও ইমরানের পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে গত ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেন। এই আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এরিকো, যা চেম্বার জজ আদালত হয়ে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
পরে আপিল বিভাগ দুই শিশুকে তাদের মায়ের কাছে রাখার আদেশ দেন। বাবা শিশুদের সঙ্গে নির্ধারিত সময়ে দেখা করতে পারবেন বলেও আদেশে বলা হয়। পাশাপাশি আবেদনকারীপক্ষকে (শিশুদের মা) নিয়মিত লিভ টু আপিলও দায়ের করতে বলা হয়। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ আদেশ প্রকাশের পর শিশুদের মা গত ২ ফেব্রুয়ারি নিয়মিত লিভ টু আপিল করেন। এর ওপর শুনানি শেষে এই আদেশ দেওয়া হয়।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘দুই শিশুকে তাদের বাবার হেফাজতে আটক রাখা বেআইনি ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের এর আগের আদেশের পর দুই শিশু কূটনৈতিকপাড়ায় অবস্থিত একটি আবাসিক হোটেলে তাদের মায়ের সঙ্গে আছে। এখন ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত শিশুরা আগের মতোই মায়ের কাছে থাকবে।’