আজ রবিবার ৫ মে ২০২৪, ২১শে বৈশাখ ১৪৩১

অমর কৃতকর্মের মাঝে আদালত খাঁন বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল

Author Thedaily Shangu | প্রকাশের সময় : শনিবার ১১ নভেম্বর ২০২৩ ০৩:০৮:০০ অপরাহ্ন | সাহিত্য

মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে,

বয়সের মধ্যে নহে

জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও পৃথিবীতে মানুষ স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকে তার কীর্তির মাঝে, সে কীর্তি মানুষের কর্ম সাধনারই ফল। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সে জগত সংসার হতে নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু কীর্তিমান ব্যক্তির ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে না। তেমনি একজন ক্ষণজন্মা আকাশ সমান মহান পুরুষ মরহুম আদালত খাঁন চৌধুরী। ১৯০৯খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি উপজেলার লেলাং ইউনিয়নের শাহনগর গ্রামের জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা উপমহাদের প্রখ্যাত জমিদার মোখলেছুর রহমান মাতা ফাতেমা চৌধুরানী। পিতার ব্যবসার সুবাদে আদালত খাঁনের বেড়ে উঠা ও ব্যবসা মিয়ানমারের (বার্মা) রাজধানী ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) শহরে। উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও কর্মদক্ষতার গুনে তিনি অল্প সময়ে সামরিক-বেসামরিক মহলে খ্যাতিমান হয়ে উঠেন। যুগ-যুগান্তরে উপমহাদেশের আজদী ও ইসলামী আন্দোলনের অগ্রনায়ক আদালত খাঁন। তিনি ছিলেন একাধারে স্বদেশপ্রেমিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও ইসলামী গবেষক।

তখনকার শতকরা ৮০ শতাংশ মানুষ ছিল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। যার ফলে প্রতিনিয়ত অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হতো মানুষদের। আর তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থাও ছিলো কুসংস্কারে ভরা। ঠিক ওই সময়ে সমাজের কুসংস্কার দূর করে সকলের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে নিজ গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন জনহিতৈষী আদালত খাঁন। ১৯৩১খৃষ্টাব্দে তিনি শাহনগর সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নয় দশক ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলছে ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়টি। পরবর্তী ১৯৫৮খৃষ্টাব্দে শাহনগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নিভৃত পল্লী এলাকার সমৃদ্ধ এই বিদ্যালয়গুলো শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরিতে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা গুণী ব্যক্তিত্ব এই স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন।

১৯৪৩খৃষ্টাব্দে দুর্ভিক্ষের সময় নিজ ব্যয়ে লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। ১৯৬০খৃষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী তিনি রিলিফ কমিটি গঠন করে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান আদালত খাঁন। "ফাতেমা চেরিটেবল ডিস্পেন্সারী" নামে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্টা করেন। তিনি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা, মসজিদ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে অকাতরে দান করতেন। ১৯৪৫খৃষ্টাব্দে কলকাতায় প্রাক্তন মন্ত্রী এডভোকেট নুরুল হক চৌধুরীর সাথে অবস্থানের সময় একজন কর্ণেলের অনুরোধে তিনি দামোদর বিদ্যুৎ প্রকল্প ও ফোর্ড উইলিয়ামের পুনঃ নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যবসা-বানিজ্য সম্প্রসারণ করেন। তিনি রাজনীতিতে বৃটিশ সম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং স্বদেশী ও খেলাফত আন্দোলনের সমর্থক অখন্ড ভারতীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। মাওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর ধর্মীয় মুরীদ এবং রাজনৈতিক ভাবে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, আবুল কালাম আজাদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজেম আলী মাস্টার, শরৎ বোস, আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, জে.এম. সেনসহ তখনকার নেতৃস্থানীয় অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার।

আদালত খাঁন ১৯৪৭খৃষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর তিনি তাঁর ব্যবসা-বানিজ্য গুটিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এর পর সামাজিক উন্নয়ন ও রাজনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং দেশ সেবার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৫১খৃষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অবৈতনিক পোর্ট কমিশনার নিয়োগ হয়। পরবর্তী তিনি ভাষা আন্দোলনের অংশ নেওয়ার জের হিসাবে তিনি ১৯৫৩খৃষ্টাব্দে উক্ত পদ ত্যাগ করেন। তখনকার সময়ে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের এক সাথে সদস্য থাকতে পারতেন বিধায় তিনি কিছুদিন মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৪খৃষ্টাব্দে নির্বাচনী প্রচারণার সময় খাজা নাজিম উদ্দীন, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খাঁন ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীসহ অনেক নেতৃবর্গ তাঁর চট্টগ্রাম কলেজস্থ বাসভবনে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিভিন্ন সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৭১খৃষ্টাব্দ যুদ্ধের সময় আদালত খাঁন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে অনেক লাঞ্চিত হয়েছেন। যুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার ও শীতবস্ত্রসহ  বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী তাঁর পরিবার ও স্বজনরা দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর বড় ছেলে শের খাঁন চৌধুরী ও ভাইপো ওসমান গণি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাঁর ভাই মিয়া মোহাম্মদ ইদ্রীস স্বাধীনতা পরবর্তী লেলাং ইউনিয়নের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সংসদ সদস্য নুরুল আলম চৌধুরী, ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম ও  পাইন্দং ইউনিনের সাবেক চেয়ারম্যান ও পাইন্দং স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম তাঁর বোনের পুত্র। চট্টগ্রামের সাবেক সিভিল সার্জন ও বিএমএ’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী তাঁর ভাইপো। তাঁর স্বজনরা অনেকে দেশ-বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন।

১৯৭১খৃষ্টাব্দ বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর বাংলাদেশকে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সাথে আদালত খাঁনের অনেক পত্রালাপ এবং তাঁর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেন বলে জানা যায়। সমাজসেবার পাশাপাশি তিনি ছিলেন লেখালেখি ও সাহিত্যি চর্চা করতেন, তার লেখা বই গুলোর মধ্যে বাংলায় "স্বাধীনতার পর সমাজ", স্বাধীনতার পরবর্তী সমস্যা ও ইংরেজিতে "Our Paradise"। 

১৯৭৯খৃষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর আলোর পথে নিবেদিত সেই মহাপ্রাণ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম কলেজস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। কাজেম আলী স্কুল মাঠে তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদের ইমাম আবদুল আহাদ আল মাদানী। জানাজা শেষে চট্টগ্রামের মিসকিম শাহ'র কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করলে অনিবার্যভাবে একদিন তাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এ পৃথিবীতে তিনি আপন কীর্তির মহিমায় লাভ করেন অমরত্ব। কীর্তিমান স্বল্পায়ু হলেও তার সৎ কাজ, অম্লান কীর্তি পৃথিবীর মানুষের কাছে তাকে বাঁচিয়ে রাখে। একথা সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে, মানব জীবনের প্রকৃত সার্থকতা কর্মের সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল। অমর কৃতকর্মের মাঝেই আদালত খাঁন বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

 

লেখক: মোস্তফা কামরুল- সংবাদকর্মী ও সংগঠক