সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পূর্ণ হলো সোমবার (৩১ জুলাই)। এই হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজারে কমেছে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা। গত তিন বছরে পুলিশের সঙ্গে একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একজন নিহত হয়েছেন। সে হিসাবে নেই বললেই চলে ‘বন্দুকযুদ্ধ’। সিনহা হত্যার আগে ওসি প্রদীপের সময়ে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ২২ মাসে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১২৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ ও বরখাস্ত পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে সিনহাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। সেইসঙ্গে ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সিনহা হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একটি ‘সাজানো’ মামলা করেছিলেন টেকনাফ থানায়। পরে পুলিশ আরও দুটি (টেকনাফে একটি, রামুতে একটি) মামলা করেছিল। ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলার পরদিন ৬ আগস্ট প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে এবং ৮৩ জনকে সাক্ষী উল্লেখ করে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন র্যাব-১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। এরপর বিচারকাজ শুরু করেন আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য তিনটি তারিখ ধার্য থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা নেওয়া সম্ভব হয়নি। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আট দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে প্রথম দফায় ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে দুই জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। দ্বিতীয় দফায় ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় আরও চার জনের। তৃতীয় দফায় ২০ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে সম্পন্ন হয় আট জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা।
টেকনাফ মডেল থানা
চতুর্থ দফায় ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর দুই দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা করা হয় ছয় জনের। পঞ্চম দফায় ১০ থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে ১৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। ৬ষ্ঠ দফায় ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয় ২৪ জনের। সপ্তম দফায় ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ছয় জন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে পাঁচ জনের জেরা সম্পন্ন হলেও তদন্ত কর্মকর্তার জেরা অসম্পূর্ণ ছিল। অষ্টম দফায় ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়।
এরপর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন আদালত।
২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন। একইসঙ্গে টেকনাফ থানার সাবেক এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের পর গত তিন বছরে কক্সবাজারে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি বললেই চলে।’
সিনহা হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত উল্লেখ করে ফরিদুল আলম, ‘আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে। রায়ের পর প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকতের ডেথ রেফারেন্স (মামলার যাবতীয় নথি) হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছেন অভিযুক্তদের আইনজীবীরা। এ বিষয়ে এখনও শুনানি শুরু হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, আপিলেও হাইকোর্টে তাদের সাজা বহাল থাকবে। বর্তমানে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি ঢাকার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার রয়েছেন।’
মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বলেন, ‘আদালতের প্রতি আমাদের সম্মান আছে। আদালতের রায়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। প্রথম যে দুজন আছেন, যাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। সেই রায় যেন কার্যকর হয়। এখন আমরা ফোকাস হারাতে চাই না। এতে রায় কার্যকরে বাধা আসতে পারে। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য রায় কার্যকরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। হাইকোর্টেও এই রায় বহাল থাকবে বলে আশা করছি।’