আজ বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গ্রেনেড হামলার ১৯ বছর আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : সোমবার ২১ অগাস্ট ২০২৩ ১২:৩৯:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

 

 

দেশের ইতিহাসে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জমান বাবর ও উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তদন্তে গাফিলতি ও অন্যান্য অভিযোগে পুলিশ এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাসহ আরও ১১ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে। ঘটনার পর থেকেই এ মামলার বেশ কয়েকজন অভিযুক্ত রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বলছে, তারা পালিয়ে থাকা আসামিদের খুঁজে বের করতে কাজ করছে। তবে তারেক রহমান ছাড়া বাকি পলাতক আসামিরা কে কোথায় আছেন, তার সঠিক তথ্যও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।

 

 

মামলার রায়

 

 

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ এই গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আসে ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর। দীর্ঘ সাত বছর বিচারিক কার্যক্রম চলে। এ সময়ে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি শেষে ৪৯ জন আসামিকে দণ্ড দিয়ে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। এ রায় ঘোষণারও পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়েছে। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে ডেথ শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।

 

 

দণ্ডিত আসামিরা কে কোথায়?

 

গ্রেনেড হামলা মামলায় প্রথম আসামি ছিলেন ২২ জন। অধিকতর তদন্তের পর সম্পূরক চার্জশিটে আরও ৩০ জন যুক্ত হলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ জনে। এ মামলার যখন রায় হয় তখন আসামি ছিলেন ৪৯ জন। কারণ, এ মামলার বিচার চলার সময়ে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় আদালত আসামির তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দেন।

 

 

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর যখন মামলার রায় ঘোষণা করা হয়, তখন ৪৯ আসামির মধ্যে পলাতক ছিলেন ১৮ জন। পলাতকদের মধ্যে পুলিশের সাবেক দুই উপ-কমিশনার (ডিসি) খান সাঈদ হাসান এবং ওবায়দুর রহমান খানও ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠান। পুলিশের খাতায় বর্তমানে পলাতক আছেন ১৩ জন। যাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও রয়েছেন। ২০২১ সালে কারাগারে থাকা অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১৫ আগস্ট তিনি মারা যান। জামিনে আছেন ৮ জন। বর্তমানে কারাগারে আটক আছেন ২৭ জন।

 

পুলিশ কর্মকর্তারা সবাই জামিনে

 

পুলিশের সাবেক তিন আইজি, দুই ডিসি এবং সিআইডির সাবেক তিন কর্মকর্তাকেও এ মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সিআইডির কর্মকর্তারা তদন্তে সঠিক দায়িত্ব পালন না করায় তাদের সাজা দেওয়া হয়। সাজা পাওয়া পুলিশের সব কর্মকর্তাই বর্তমানে জামিনে রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ওইসব পুলিশ কর্মকর্তা হচ্ছেন–সাবেক আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, ডিএমপির সাবেক দুই উপ-কমিশনার খান সাঈদ হাসান ও ওবায়দুর রহমান খান, সিআইডির সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমান।

 

পুলিশের খাতায় পলাতক ১৩

 

তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরী: পলাতক আসামিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পুলিশের খাতায় ১৬ জন পলাতক থাকলেও তারেক রহমান রয়েছেন লন্ডনে। তিনি প্রকাশ্যেই বিএনপির রাজনীতি পরিচালনা করছেন। মামলার আরেক আসামি বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব চৌধুরী আবদুল হারিছ ওরফে হারিছ চৌধুরীর বিষয়টি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে তিনি মারা গেছেন বলে জানান তার চাচাতো ভাই আশিক উদ্দিন চৌধুরী। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে অপর একটি ট্যাবলয়েড দৈনিকের খবর অনুযায়ী হারিছ চৌধুরী বাংলাদেশেই আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মারা যান। জঙ্গি নেতা মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ লোকমান হাওলাদার, মুফতি আবদুল হাই এবং মুফতি শফিকুর রহমানকে র‌্যাব বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করে।

 

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী পলাতক অন্য আসামিরা হচ্ছেন– কুমিল্লার মুরাদনগরের বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদ, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার ওরফে ডিউক, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন মিয়া, বাবু রাতুল আহমেদ, মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল এবং মাওলানা লিটন ওরফে দেলোয়ার হোসেন ওরফে জোবায়ের। পলাতক বেশিরভাগ আসামির অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও অন্ধকারে। বিগত ১৯ বছরেও পলাতকদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে তাদের খুঁজে বের করতে কাজ করে যাচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।

 

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন  বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কাজ করা হচ্ছে। আসামিরা কে কোথায় আছেন তা জেনেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের এনসিবি ইন্টারপোলের সদর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। খুব শিগগিরই তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।

 

ইন্টারপোলের রেড নোটিশে তিন নাম

 

হারিছ চৌধুরী: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন চৌধুরী আবদুল হারিছ ওরফে হারিছ চৌধুরী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হারিছ চৌধুরীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার অবস্থান জানতে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা আছে। এক সময় পুলিশ বলতো তিনি ভারত, মালেয়েশিয়া কিংবা লন্ডনে আছেন। এখন সেটাও বলছেন না। ২০২২ সালের শুরুতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হলেও তারা এ নিয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে তাদের কাছে সঠিক কোনও তদন্ত প্রতিবেদন নেই। যে কারণে তারা ইন্টারপোল থেকে তার নাম বাদ দিতে অনুরোধ জানাননি।

 

২০০৭ সালে এক এগারো কিংবা ওয়ান ইলেভেনের সময় যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয় তখন তিনি সিলেটের কানাইঘাটে তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু হলে ওই বছরের ২৯ জানুয়ারি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। তখন বলা হয়েছিল তিনি সিলেটের জকিগঞ্জ দিয়ে ভারতে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে কেউই কখনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি। যে মাসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষণা করা হয়, ওই মাসেই (২৯ অক্টোবর ২০১৮) জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায়ও তিনি আসামি ছিলেন।

 

মাওলানা মোহাম্মদ তাজউদ্দিন মিয়া: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরপরই ২০০৪ সালে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান মাওলানা মো. তাজউদ্দিন মিয়া। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের এই শীর্ষ নেতা ঘটনার পরই ভিন্ন নামে পাসপোর্ট বানিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যান। তার অবস্থান শনাক্তের জন্য ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা হয়। তার সম্ভাব্য অবস্থান দক্ষিণ আফ্রিকায় বলে জানান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকেই। তাকে ফেরত আনার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৬ সালের নভেম্বরে তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেলে তার বিষয়ে সেখানকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাও করেছিলেন। তিনি একই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই।

 

রাতুল আহমেদ বাবু: ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় রাতুল আহমেদ বাবুর নামও রয়েছে। তার নামও আছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকায়। তার সম্ভাব্য অবস্থান ইতালি ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বলে ধারণা পুলিশের। 

 

পলাতক অন্য আসামিরা

 

কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ: বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ পলাতক রয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা মালেয়েশিয়াতে রয়েছেন বলে মনে করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাকে ফেরাতেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। কিন্তু ফেরানো যাচ্ছে না।

 

মো. হানিফ: হানিফ পরিবহনের মো. হানিফ এ মামলায় মৃত্দুণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। তাকে খুঁজে বের করতেও ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি করা হয়। তার সম্ভাব্য অবস্থান থাইল্যান্ড ও মালেয়েশিয়া বলে জানায় পুলিশ।

 

আনিসুল মুরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন: হরকাতুল জিহাদের অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মুরসালিন ওরফে মুরসালিন সহোদর। তারা বর্তমানে ভারতের তিহার কারাগারে সেখানকার জঙ্গি কর্মকাণ্ডের ঘটনায় আটক রয়েছে।

 

সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার ডিউক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আপন খালাতো ভাই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার ওরফে ডিউক। তিনি বর্তমানে কানাডায় আছেন বলে জেনেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। মো. ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার পাকিস্তানে অবস্থান করছেন বলে ধারণা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের। তবে কারোরই সুনির্দিষ্ট অবস্থানের কোনও তথ্য নেই পুলিশের কাছে।

 

পুলিশ সদর দফতরের বক্তব্য

 

পলাতক আসামিদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশনস) আনোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ও খুঁজে বের করতে পুলিশের পক্ষ থেকে তৎপরতার কোনও ঘাটতি নেই। আসামিরা কে কোথায় আছেন তা জেনেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ইন্টারপোলের সদর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।