আজ বাঙালির শোকের দিন। জনক হারানোর দিন। জাতির ইতিহাসে কলঙ্কের দিনও বটে। পঁচাত্তরের এই দিন (১৫ আগস্ট) ভোরে বিপথগামী কিছু বাঙালি সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিভে যায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জীবন প্রদীপ। দুষ্কৃতকারীরা জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বাঙালি জাতিকেই কলঙ্কিত করেনি, রুদ্ধ করে তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে। স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনা বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতির মাথা হেট করে দিয়েছিল। অথচ বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির মহানায়ক স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষে তখন ক্ষতবিক্ষত অবস্থা থেকে দেশ পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যস্ত ছিলেন। তখনই ঘটানো হয় ইতিহাসের নির্মম এ ঘটনা।
ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী সেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ৪৮তম বার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট)। গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি আজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুসহ সেদিনের শহীদদের স্মরণ করছে। দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। দিনটি সরকারি ছুটির দিন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা শুধু জাতির পিতাকেই হত্যা করেনি, তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, তিন পুত্র— বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, দশ বছরের শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, একমাত্র সহোদর বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, কৃষকনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, যুবনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, সাংবাদিক শহিদ সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে ঘৃণ্য ঘাতকরা এ দিনে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও খুন হন তার ‘সহকর্মী’ সেনা সদস্যদের হাতে। ঘাতকদের কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে একটি পরিবারের বেশ কয়েকজন হতাহত হন। ওই সময় দেশের বাইরে থাকায় ঘাতক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনও বাঙালি তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না বলে দৃঢ়বিশ্বাস করতেন বঙ্গবন্ধু। সে জন্য তিনি গণভবনের পরিবর্তে থাকতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের নিজ বাসভবনে। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন এই বাড়িতে বসেই। এখানে থেকেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন। সেদিন ঘাতকদের বুলেটের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে হত্যাকারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা। হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেদিন বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে নোবেল বিজয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, ‘মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, তারা যেকোনও জঘন্য কাজ করতে পারে।’
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।’ দ্য টাইমস অব লন্ডনের ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় বলা হয় ‘সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনও অস্তিত্ব নেই।’
সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিষয়টি বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘সব চেয়ে বিশাল ও ভারী যে লাশটি বাংলাদেশের নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবরের লাশ’।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের বিকাশকে রুদ্ধ করে দেওয়াই ছিল ওই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির অস্তিত্ব ও মননে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তবে সে ক্ষতের কিছুটা উপশম হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে খুনিদের বিচারের মাধ্যমে। অনেক বাধা-বিপত্তির পর বিলম্বে হলেও ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। এই বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতি তার কলঙ্কের দায় লাঘব করতে সমর্থ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে। পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।
আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রদ করে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কাজ। বিচার শেষের দিকে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে আবারও থমকে পড়ে বিচার প্রক্রিয়া। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে ত্বরান্বিত করে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দণ্ডিতদের মধ্যে কয়েকজন এখনও পলাতক রয়েছে। সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের দাবি উঠেছে বেশ কয়েক বছর আগে। সরকারের তরফ থেকেও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কমিশন আইনের একটি খসড়া ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে বলে সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক।