আজ মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১
কোরবানীকে সামনে রেখে পাচারকারীরা সক্রিয়

স্রোতের মতো নাইক্ষ্যংছড়ি-আলীকদম সীমান্ত দিয়ে আসছে গরু

Author Thedaily Shangu | প্রকাশের সময় : শনিবার ২৪ জুন ২০২৩ ১১:১০:০০ অপরাহ্ন | জাতীয়

 

 কোরবানী ঈদের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি । এর মধ্যে কোরবানীকে টার্গেট করে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি-আলীকদম মিয়ারমার সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন স্রোতের মতো দেশে ডুকছে চুরাই গরু। আইন শৃঙ্গলাবাহিনী মাঝে মধ্যে কিছু গরু আটক করলেও প্রতিদিন তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে ডুকছে হাজার হাজার গরু। এদিকে সুযোগ বুঝে পাচারের জন্য সীমান্তের ওপারে হাজার হাজার গরু অপেক্ষায় রেখেছে গরুপাচারকারী চক্র। 

আলীকদমে উপজেলা বিএনপির যুগ্মসম্পাদক ইউনুছ ও আলীকদম উপজেলা পরিষদের ভাইন্স চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিনের নেতৃত্বে গরু পাচারকারী চক্র সক্রিয় ।

 কফিল উদ্দীন আলীকদম উপজেলা,যুগ্ন সম্পাদক আলীকদম উপজেলা আ'লীগের যুগ্ন সম্পাদক ও ইউনুস বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক। বিপরীত দুটি রাজনৈতিক দলের নেতা হলেও তাদেও মধ্যে গরু চোরাচালান নিয়ে কোন বিরোধ নেই। মিলে-মিশে সীমান্তে গরু পাচার কাজে নিজেদেও বিলিয়ে দিয়েছেন তারা।

এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ির সদর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, দোছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমরান, বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম, বিএনপি সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আবছার সোহেল, ছাত্রদল সভাপতি জিয়াবুল হক, যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক আলী হোসেন মেম্বার, জামায়াত নেতা জাকের, ওসমান, জাফর, সাবের মেম্বার, আতাউল্লাহ,  সোহেল সিকদার, জসিম মেম্বার, কচ্ছপিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবু মো: ইসমাইল নোমান, আনোয়ারুল ইসলাম রাসেল, আবু ইসা, আবুল কালাম গরু চোরাকারবারীতে জড়িত।

 

জানা গেছে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০ ট্রাক গরু/ মহিষ  আলিকদম থেকে পাচার হয়। প্রতি ট্রাকে ১৫টি গরু/ মহিষ ধরে। সেই হিসাবে প্রতিরাতে ৬শত গরু? মহিষ পাচার হয়।  

 

বিভিন্ন সময় অবৈধ ভাবে মিয়ানমার থেকে নিয়ে এসে এসব গরু ও মহিষ পাচার করার সময় বিজিবি,পুলিশ,সেনা বাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান গরু মহিষ আটক করে।

  সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা যায়, গত প্রায় আট মাস ধরে পাশ্বর্বতী রাষ্ট্র মিয়ামনার থেকে একটি গরু পাচারকারী চক্র আলিকদমের স্থানীয় একটি চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে গরু ও মহিষ পাচার করে আসছে। আলিকদমে এই অবৈধ মিয়ানমারের গরু ও মহিষ পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান,ইউপি চেয়ারম্যান,ইউপি সদস্যসহ আ'লীগ ও বিএনপির নেতা কর্মী। নাম প্রকাশে অনিচ্চুক আলিকদমের সচেতন মহলের প্রতিনিধিরা জানান, মিয়ানমারের বুচিঢং রাজ্যের বকুলি এলাকার বাসিন্দা শোমেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে গরু ও মহিষ গুলো ক্রয় করে থাকেন আলিকদম বাস ষ্টেশন দানু সিকদার পাড়ার বাসিন্দা লালু প্রকাশ বার্মাইয়া লালু এবং ৪নং কুরুপ পাতা ইউপি চেয়ারম্যান ক্রাফুং ম্রো। এই দুই ব্যক্তি স্থানীয় চক্রের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে কক্সবাজার থেকে হুন্ডির মাধ্যেমে ঐ টাকা গুলো মিয়ানমারে শোমেন নামের ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে দেয়। শোমেন নামে ওই ব্যক্তি গরু ও মহিষের চালান গুলে একে একে মিয়ানমারের বুচিঢং বকুলি সীমান্ত পার করে আলিকদমের বড় আগগালা ও বড় বেতী দিয়ে আলীকদম সদরে নিয়ে আসে। আলিকদমের স্থানীয় চক্র বিএনপি নেতা ইউনুছ মিয়া,যুবলীগ নেতা সফি আলম,উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান কফিল উদ্দীন,সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফোগ্য মার্মা,ইউপি সদস্য আলী হোসেন,মোঃ হারুন,সালাউদ্দীন,রুহুল আমিন,মোঃ ইলিয়াস,নজরুল ইসলাম,জামাল সওদাগর,ছোট ইউনুছ,মোঃ ফরিদ,মোস্তফা জামাল রাশেদ ও মারুফ গরু ও মহিষের চালান গ্রহন করে। পরে গরু ও মহিষ গুলো গভীর রাতে ট্রাক যোগে চকরিয়া,কক্সবাজার,আমিরাবাদ,কেরানীহাটসহ দেশের বিভিন্ন হাটে বিক্রি করে। তারা আরো জানান,স্বল্প মুল্য দিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মিয়ানমারের থেকে গরু ও মহিষ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন হাটে বিক্রি করায় এক দিকে ক্ষতির মুখে পড়েছে স্থানীয় গরু মহিষ খামারীরা অন্যদিকে সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত। 

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বাংলাদেশ-মায়ানমারের সীমান্ত রয়েছে ৭১কিলোমিটার। যারমধ্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক সীমান্ত ঘুমধুম, জামছড়ি, জারুলিয়াছড়ি, আশারতলী, ফুলতলী এলাকায়। এই সীমান্তের দূর্গম পাহাড়ী এলাকা দিয়ে চোরাই গরু পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি ও রামু উপজেলার প্রভাবশালী মহল পর্দার আড়াল থেকে শ্রমিক পাঠিয়ে এই অবৈধ বানিজ্য করছে। এতে করে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব আদায় থেকে যেমন বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি দেশের কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে বিদেশে।

অপর দিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্তের পাহাড়ী পথে হাজার হাজার গরু প্রবেশ করছে। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও দোছড়ি ইউনিয়নের ৬-৭টি পয়েন্টে দিয়ে আসা এসব গরু সরাসরি যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজারে। সেখানকার বাজার ইজারাদার এসব চোরাই গরু বৈধতা দিচ্ছে। পরে নাইক্ষ্যংছড়ি হয়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে। রামু উপজেলার গর্জনিয়া গরুর বাজার এটি। গেল বছর এই বাজার ইজারা ডাক দেওয়া হয়েছিল ১কোটি ২০লাখ টাকা। বছর না পেরুতেই বাজারটির ইজারার শতাংশ বেড়েছে তিনগুণের চেয়ে বেশি। চলতি বছর এই বাজারের ইজারা ডাক দেওয়া হয় ৪কোটি ৯৬লাখ টাকায়। এর মূল কারণ মায়ানমারের চোরাই গরু বানিজ্য। সপ্তাহের বৃহস্পতি ও সোমবার প্রতি হাটের দিন ছাড়াও বাজার ইজারাদার গরুর রশিদ বানিজ্য করে আয় করছে লক্ষ লক্ষ টাকা। আর এই গরুর বাজার কেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। আগে বাজারে রশিদ দেওয়া হলেও এখন আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান আতংকে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে রশিদ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, সীমান্ত থেকে পুরো সড়ক অবৈধ হয়ে আসা গরুর বৈধতা দিচ্ছে বাজার ইজারাদার। যার কারনে বাজারে এখন দেশীয় খামারীরাও গরু আনতে অনীহা প্রকাশ করছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, গর্জনিয়া বাজার ছাড়াও রশিদ বই নিয়ে অন্তত ৩০-৪০জন যুবক হাইস্কুলপাড়া, চাকমারকাটা, হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটা, ডাক্তারকাটা, সুইচ গেট এলাকায় অবস্থান করে থাকে। তারা মূলত বিপরীতদিক থেকে আসা এবং মানুষের বাসা বাড়িতে মজুদ রাখা প্রতিটি গরু রশিদ সরবরাহ করে। গরু বিক্রেতার কাছ থেকে প্রতিটি গরু ২হাজার এবং ক্রেতার কাছ থেকে ১হাজার টাকা আদায় করা হয়। তবে রশিদপত্রে গরুর মূল্য লেখা থাকলেও আদায়কৃত চাঁদার অংশ উল্লেখ করেনা ইজারাদার। পরে গরুগুলো জামছড়ি-রূপনগর এবং গর্জনিয়া বাজার-ফাক্রিকাটা হয়ে পাচার হয় বিভিন্ন স্থানে। পরিবহণযোগে নেওয়ার পথে ইউনিয়ন পরিষদ, পরিবহণ সমিতি, জেলা পরিষদসহ স্থানীয় মাস্তান প্রকৃতির যুবকরাও চাঁদা আদায় করে এসব গরু থেকে। যার কারনে ঘাটে ঘাটে রশিদ সরবরাহ করা চোরাই গরু বৈধতা পেয়ে যাচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন থেকে শুরু করে আলীকদম সীমানা পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মায়ানমার সীমানা রয়েছে প্রায় ৭১কিলোমিটার। এই সীমানা এলাকায় কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির ৮টি এবং নাইক্ষ্যংছড়ি ১১বিজিবির অধীনে ১৫টি বর্ডার অবজারবেশন পোষ্ট রয়েছে। যারমধ্যে বর্তমানে ৪৭-৪৮ পিলারের মধ্যবর্তী পাহাড়ী এলাকা দিয়ে মায়ানমার থেকে চোরাই গরু আনা হচ্ছে। এই পয়েন্টগুলো দূর্গম এলাকা হওয়ার সুবাধে চোরাকারবারীরা পাহাড়ী পথ বেয়ে গরুগুলো সরাসরি নিয়ে যায় কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের গর্জনিয়া বাজারে।  

 

অপর দিকে অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে শত শত দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোরদের জড়ানো হচ্ছে গরু পাচারে। এসব শিশুদের মধ্যে কেউ মায়ানমার সীমান্তে যাচ্ছে গরু আনতে আবার কেউ রামুর হাজিরপাড়া, মৌলভীরকাটা, চাকমারকাটা, ডাক্তারকাটা, ফাক্রিকাটা, ঢাকভাঙ্গা ও নাইক্ষ্যংছড়ির রূপনগর সড়ক ব্যবহার করে চোরাই গরু পৌছে দিচ্ছে গন্তব্যে। সরেজমিনে অনুসন্ধানে এসব শিশুরা ক্যামরা দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যায়, কেউ মুখ ঢেকে সটকে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের ঘরে রাখতে এবং অন্যান্য কাজে শ্রমিক সংকটে ভুগছে পেশাজীবিরা।

 

এব্যপারে বান্দরবান পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম জানান, আলিকদমে মিয়ানমার থেকে অবৈধ ভাবে নিয়ে আসা একটি গরু মহিষ পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন সময় পুলিশ,বিজিবি,সেনা বাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমান গরু মহিষ জব্দ করা হয়েছে। পরে জব্দকৃত গরু মহিষ কাষ্টমসের মাধ্যমে নিলামে বিক্রি করা হয়েছে। গরু ও মহিষ পাচাকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন সব সময় সর্তক রয়েছে।