চট্টগ্রামের ৯২ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুটি সংস্কার করছে রেলওয়ে। এবার সংস্কারকাজে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর আগে সেতু মজবুত করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কারকাজ শেষ করতে লাগতে পারে তিন মাসের বেশি। এই সময়ে সেতু দিয়ে ট্রেন ও যান চলাচল বন্ধ থাকবে। যানবাহন পারাপারের জন্য কর্ণফুলী নদীতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে তিনটি ফেরি। তবে সংস্কারকাজ শুরু হতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে শুক্রবার (২১ জুলাই) আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ফেরি চালানো থেকে শুরু করে দেখভাল করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় জনবল। তবে শনিবার (২২ জুলাই) সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরি চলাচল শুরু হয়নি।
এদিকে, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের কাজ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করে উদ্বোধনের চিন্তা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সে অনুযায়ী এগোচ্ছে প্রকল্পের কাজ।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শক দলের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করা হচ্ছে। বর্তমানে সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনে ১০ টন ভারী ইঞ্জিন চলাচল করে। সেতু পার হওয়ার সময় গতি থাকে সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার। তবে কক্সবাজারগামী ইঞ্জিনের ওজন হবে ১২-১৫ টন। ট্রেনের গতি হবে ৮০-১০০ কিলোমিটার। এ কারণে সংস্কার ছাড়া দোহাজারী-কক্সবাজার রেল যোগাযোগের সুফল মিলবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংস্কারকাজ শুরু হলে সেতু দিয়ে যান এবং ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে উল্লেখ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘সংস্কারকাজ চলা অবস্থায় ফেরি সার্ভিস চালু থাকবে। ইতোমধ্যে তিনটি ফেরি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ফেরিতে কোন ধরনের যানবাহন থেকে কত টাকা ভাড়া রাখা হবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো দিন থেকে ফেরি সার্ভিস চালু হবে।’
তিনি বলেন, ‘শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরি সার্ভিস উদ্বোধন করা হয়েছে। তিনটি ফেরি প্রস্তুত আছে। তবে কবে থেকে সেতুর সংস্কারকাজ শুরু হবে, তা আমার জানা নেই।’
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা জানান, এর আগে ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুতে বড় ধরনের সংস্কারকাজ করা হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালে আরেক দফা সংস্কার করা হয়েছিল। বর্তমানে সেতুর ওপর দিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনে ট্রেনের ১০ টন ভারী ইঞ্জিন চলাচল করে। এ সময় গতি থাকে সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার। কিন্তু কক্সবাজারগামী ট্রেনের ইঞ্জিনের ভর হবে ১২-১৫ টন। ট্রেনের গতি সর্বোচ্চ ৮০-১০০ কিলোমিটার। কালুরঘাট সেতুর বর্তমান অবস্থার কারণে এই গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে না। অন্তত ৪০-৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা আছে। এ জন্য বুয়েটের পরামর্শক দলের পরামর্শ অনুযায়ী সেতু সংস্কার করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘কালুরঘাট রেলসেতুর সংস্কারের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসেই সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে এখনও শুরু হয়নি। কবে থেকে সংস্কারকাজ শুরু হবে, সে দিন-তারিখ এখনও আমাদের জানানো হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় মালামাল আনার কাজ শুরু করেছে। আশা করছি, শিগগিরই কাজ শুরু হবে।’
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুটি সংস্কারের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেতুটিতে যে পরিমাণ সংস্কারকাজ রয়েছে, তা শেষ করতে ছয় মাস সময় লাগতে পারে বলে রেলওয়েকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে আরও আগে কাজ শেষ করার তাগাদা দেওয়া হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। সে অনুযায়ী কাজ হবে।’
সেপ্টেম্বরের মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের চলমান কাজ শেষ করে ট্রেন চলাচল শুরুর চিন্তা করছি আমরা এমনটি জানালেন দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে ৮২ কিলোমিটার রেললাইন বসানোর কাজ শেষ। প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৬ শতাংশ। রেললাইনের ওপর থাকা ছোট-বড় ব্রিজ-কালভার্টের কাজও শেষ হয়েছে। এখন মেকানিক্যালের কাজ চলমান আছে।’
সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নিজাম উদ্দীন বলেন, ‘কালুরঘাট সেতুর নিচে তিনটি ফেরি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রথমে দুটি চলাচল করবে। যানবাহনের চাপ থাকলে অপরটিও চালানো হবে। সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরি চালু হয়ে যাবে।’
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ এবং সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এতে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৯৩১ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি নামের সেতু নির্মাণকারী একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। যদিও পরে দোহাজারী পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয় এই রেললাইন। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় সেতুটি সংস্কার করেছিল রেলওয়ে। কিন্তু এরপরও সেতুটির অবস্থা জরাজীর্ণ। এ অবস্থায় সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়াগামী গাড়িও চলাচল করে। ট্রেন চলাচল করলে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। একমুখী যান চলাচলের কারণে সব সময় যানজট লেগে থাকে। যাত্রী ও চালকদের প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হয়।