চট্টগ্রামে গত ছয় মাসে যা ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, চলতি মাসে তার প্রায় চার গুণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। গত চার দিনে শনাক্ত হয়েছেন চার শতাধিক। এর মধ্যে ২৩ জুলাই ১১১, ২২ জুলাই ১৪৩, ২০ জুলাই ৬৬ এবং ১৯ জুলাই ১১৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। রোগীর ঊর্ধ্বমুখী এই হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা করেছেন চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষকে সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি মশার প্রজননরোধে সিটি করপোরেশনকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইতোমধ্যে বন্দর নগরীর ৪৯২টি স্থান ডেঙ্গুর হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছে সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডের ৪৩৫টি স্থান এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাকি ৫৭টি স্থান শনাক্ত হওয়া রোগীর ওপর ভিত্তি করে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ছয় মাসে যা ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন, চলতি মাসে তার প্রায় চার গুণ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, নগরীর এক নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ২৫টি, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে ১৫টি, চার নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে ১৫টি, পাঁচ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডে ৫২টি, ছয় নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে ২৯টি, সাত নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে ১৭টি, আট নম্বর শুলকবহর ওয়ার্ডে ৩০টি, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ১৩টি, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ছয়টি, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে ১৬টি, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে ১২টি, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে পাঁচটি, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে সাতটি, ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে পাঁচটি, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে ৯টি, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাতটি, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে ১৩টি, ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডে ১২টি, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে ১৪টি, ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ডে সাতটি, ২৩ নম্বর উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আটটি, ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে দুটি, ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে ১২টি, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে ১০টি, ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে ১২টি, ২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে ১৬টি, ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ী ওয়ার্ডে আটটি, ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে তিনটি, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৫ নম্বর বক্সিরহাট ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৭ নম্বর মনিরনগর ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্য হালিশহর ওয়ার্ডে একটি, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে ১৪টি, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে ১৬টি এবং ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে চারটি স্থান এডিস মশার হটস্পট (রেডজোন) অর্থাৎ প্রজননস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পাশাপাশি শনাক্ত হওয়া রোগীর ওপর ভিত্তি করে আরও ৫৭টি স্থান চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর এসব প্রজননক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেও লিফলেট বিতরণ, মাইকিংসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের ৪৯২টি স্থান এডিস মশার প্রজননস্থল হিসেবে রেডজোনভুক্ত করে মশা নিধনের কার্যক্রম চলছে বলে জানালেন সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘চিহ্নিত স্থানগুলোতে লার্ভিসাইডসহ বিভিন্ন মশা নিধনকারী ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে সাফল্যপ্রাপ্তিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু অসচেতন বাড়ি মালিকের ছাদে জমে থাকা পানি। বিশেষ করে সুইমিংপুল আর ছাদবাগানগুলো মশার আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। অনেক বাড়ির মালিক নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে আমাদের কর্মীদের ছাদে উঠতে দেন না। আমরা মশার ওষুধ ছিটাচ্ছি নালা-নর্দমায়। কিন্তু আবাসিক ভবনগুলাে হয়ে উঠেছে মশার বড় আবাসস্থল। তাই বাধ্য হয়ে ড্রোন দিয়ে ছাদ পর্যবেক্ষণ করতে হয়।’
সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম বলেন, ‘মশার সংক্রমণ কমাতে আমরা ১০০ দিনের ক্র্যাশ প্রোগ্রামের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জোর দিচ্ছি। আরবান ভলান্টিয়ার ও রেডক্রিসেন্টের ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে আটটি টিম গঠন করে নগরীর আটটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মাইকিং এবং লিফলেট বিতরণ করছি। বাসায় জমে থাকা পানি অপসারণের আহ্বান জানানো হচ্ছে। মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’
মশা নিধনে নগরীর ৬০টি আবাসিক এলাকায় অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছেন সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহি। তিনি বলেন, ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রামকে সফল করতে মশা নিধনে লোকবল বাড়ানো হয়েছে। চিহ্নিত হটস্পটে ওষুধ ছিটানো কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘চলতি বছর জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন দুই হাজার ৩৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন। মারা যাওয়া ২২ জনের মধ্যে ১১ জনই শিশু। বাকিদের মধ্যে পুরুষ ছয় ও নারী পাঁচ জন।’
গত সাত মাসে আক্রান্তের বর্ণনা দিয়ে সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘জুলাই মাসে এক হাজার ৫৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১৩ জন। জুনে আক্রান্ত ২৮২, মৃত্যু হয়েছে ছয় জনের। মে’তে ৫৩, এপ্রিলে ১৮, মার্চে ১২, ফেব্রুয়ারিতে ২২ ও জানুয়ারিতে ৭৭ জন আক্রান্ত হন। জানুয়ারিতে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছেন তিন জন।’
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার দিন দিন বাড়ছে। আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ডেঙ্গু মশাবাহিত রোগ। এই রোগ থেকে রক্ষায় মশা নিধনের বিকল্প নেই। তাই মশা নিধনে তৎপর হওয়ার জন্য সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি আমরা। পাশাপাশি রোগীদের সতর্ক করা হচ্ছে।’