আজ বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১

টানেলে নিয়ম মানছেন না চালকরা, ঘটছে দুর্ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক: | প্রকাশের সময় : সোমবার ৬ নভেম্বর ২০২৩ ০৯:১১:০০ পূর্বাহ্ন | জাতীয়

 

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম। সেতু-কালভার্ট ও সড়কের সঙ্গে এদেশের মানুষ দীর্ঘ পরিচিত হলেও টানেলের সঙ্গে যোগাযোগটা এবারই প্রথম। ফলে টানেলের ভেতর গাড়ি চালানোর জন্য সব ধরনের নিয়মনীতি বলে দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট গতিসীমা বেঁধে দেওয়া হলেও তা মানছেন না অনেক চালক। ইতোমধ্যে প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর সমালোচনা শুরু হয়। ইতোমধ্যে ঘটেছে দুর্ঘটনাও। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে গত এক সপ্তাহে তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

 

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাত ৯টার দিকে প্রাইভেটকারকে পেছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাইভেটকারের পেছনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। এ সময় প্রাইভেটকারের চার যাত্রী আহত হন। টানেল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টানেলের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে টানেলের ভেতরে প্রবেশ করার পর একটি প্রাইভেটকারকে পেছন থেকে বাস ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে টানেলের নিরাপত্তাকর্মীরা গাড়ি দুটি জব্দ করেন। এর আগে আরও দুটি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে টানেলের ভেতর।

 

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানেলের ভেতরে পরিবহনের শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করছে টানেল কর্তৃপক্ষ। এতে কার্যকর কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না সিএমপির ট্রাফিক পুলিশ। পুলিশের গাড়ি টানেলের ভেতর প্রবেশ করলে টোল দিতে হয়। ফলে সেখানে গিয়ে পরিবহনের শৃঙ্খলা দেখভালে আগ্রহ কম পুলিশের।  

 

 

টানেলের নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন, গত ২৯ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে যানবাহন চলাচলের জন্য টানেল উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ওই দিন স্বাভাবিকভাবে যান চলাচল করেছিল। কিন্তু প্রথমদিন রাতে প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, এরপর টানেলের ভেতর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা, নির্ধারিত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে কম-বেশি গতিতে চালানোর ফলে ঘটেছে দুর্ঘটনা। নিয়মকানুন মানছেন না চালকরা।

 

 

গত ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে টানেলের ভেতর কার রেসিং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল কয়েকজন যুবক। দামি কার নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতেছিল তারা। প্রতিযোগিতা করে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে সমালোচনা হয়। ওই প্রতিযোগিতায় সাতটি প্রাইভেটকার অংশ নেয়। এ ঘটনায় ১ নভেম্বর রাতে নগরীর কর্ণফুলী থানায় মামলা করা হয়। সড়ক পরিবহন আইনে মামলাটি দায়ের করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম। মামলার এজাহারে প্রাইভেটকারগুলোর নম্বর উল্লেখ করে চালকদের আসামি করা হয়।

 

মামলার এজাহারে বলা হয়, টানেল কর্তৃপক্ষ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক্রমে মোটরযানের গতিসীমা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করা হয়। টানেলের প্রবেশমুখ, ভেতরসহ বিভিন্ন দৃশ্যমান স্থানে গতিসীমা সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। ২৯ অক্টোবর রাত ১১টায় ক্রসিং এলাকায় সাতটি প্রাইভেটকার নিয়ে প্রতিযোগিতা করে অজ্ঞাত চালক এবং তাদের সহযোগীরা সর্বোচ্চ গতিসীমা লঙ্ঘন করেছে। গাড়িগুলো রেসলিং, ওভারটেকিং ও বিপজ্জনকভাবে চালানোসহ যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। পরে টানেলের সিসিটিভি মনিটরিং কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে সাতটি গাড়ির নম্বর শনাক্ত করে।

 

কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জহির হোসেন  বলেন, ‘টানেলের ভেতর কার রেসিং প্রতিযোগিতার ঘটনায় টানেল কর্তৃপক্ষ মামলা করেছে। এতে সাতটি প্রাইভেটকারের নম্বর উল্লেখ করে অজ্ঞাত চালকদের আসামি করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

টানেল এলাকার মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের কোনও কার্যক্রম নেই বলে জানালেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বন্দর-বিভাগের উপ-কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান।  তিনি বলেন, ‘টানেলের বাইরে পরিবহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে ট্রাফিক পুলিশ। টানেল কর্তৃপক্ষ ভেতরে ট্রাফিক সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। ভেতর প্রবেশ করলে পুলিশের গাড়িকে টোল দিতে হয়। পুলিশ সরকারি কাজে টানেলে যাবে, টোল দেবে কেন? তবে টানেল কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা চাইলে আমরা অবশ্যই করবো।’   

 

একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের বন্দর বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা। তিনি বলেন, ‘টানেল দিয়ে পুলিশের গাড়ি প্রবেশ করলে টোল দিতে হচ্ছে। এ কারণে পুলিশ কোনও কারণ ছাড়া টানেলে প্রবেশ করছে না। তবে টানেলের দুই পাশে পরিবহনের শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করে ট্রাফিক পুলিশ।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু টানেল চালুর পর থেকে নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স এটির নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রাইভেটকার নিয়ে রেসিংয়ের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। আমরা মামলার তদন্ত করে জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করছি। শুক্রবার রাতে একটি প্রাইভেটকার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। মামলা হলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

 

বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের টোল ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘টানেলের ভেতর দিয়ে যে গাড়ি প্রবেশ করুক, সবগুলোকেই টোল দিতে হয়। টোল ব্যতীত কোনও গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ৫৪ হাজার ৬৫টি গাড়ি পার হয়েছে। এক কোটি ২১ লাখ ৮১ হাজার ২০০ টাকা টোল আদায় হয়েছে।’  

 

নিয়মনীতি না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন টানেল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী (অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ) কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস।

 

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিজেও টানেল দিয়ে যাওয়ার সময় টোল দিয়ে পার হয়েছেন। টানেল পার হতে সবাইকে টোল দিতে হবে। এটাই নিয়ম। প্রাথমিকভাবে ছয়টি গাড়ির টোল ফ্রি করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের দুটি, ম্যাজিস্ট্রেটের দুটি এবং নৌবাহিনীর দুটি। টানেলে দায়িত্ব পালনের কারণে এসব গাড়িকে টোল দিতে হয় না। সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় কোনও সরকারি লোক যদি টোল দেন পরবর্তীতে ওই টাকা ফেরত দেয় সরকার। এটা কাজের একটা অংশ।’

 

 

গত ২৮ অক্টোবর বেলা সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তে ফলক উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে বহুল প্রতীক্ষিত টানেল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নিজ হাতে টোল দিয়ে টানেল পার হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে আয়োজিত জনসভায় যোগ দেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নিজের গাড়ির জন্য ২০০ টাকা এবং বহরে থাকা ২০টি গাড়ির জন্য চার হাজার টাকা টোল দেন।

 

টানেল পাড়ি দিতে প্রাইভেটকার ও পিকআপ ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস ২৫০ টাকা, বাস (৩১ সিটের কম) ৩০০ টাকা, বাস (৩২ সিটের বেশি) ৪০০ টাকা, বাস (৩ এক্সেল) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) ৪০০ টাকা, ট্রাক (৫ দশমিক ০১ থেকে ৮ টন) ৫০০ টাকা, ট্রাক (৮ দশমিক ০১ থেকে ১১ টন) ৬০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার (৩ এক্সেল) ৮০০ টাকা, ট্রাক ও ট্রেইলার (৪ এক্সেল) ১০০০ টাকা টোল দিতে হয়।

 

শুরুতে টানেল নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে ৫ হাজার ৯১৩ দশমিক ১৯ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাকি টাকা দেয় বাংলাদেশ সরকার।