চট্টগ্রামে প্রয়োজনের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম থাকায় চরম দুর্ভোগে আছে নগরবাসী। নগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ দুর্ভোগও বেড়েই চলেছে। সড়কে নামছে না নতুন বাস-মিনিবাস। যেগুলো আছে তার বেশিরভাগই লক্কর-ঝক্কর, ফিটনেস-পারমিটবিহীন। আবার বেশকিছু গণপরিবহন ব্যস্ত থাকে কল-কারখানায় শ্রমিক আনা-নেওয়াসহ ‘রিজার্ভ’ ভাড়ায়। যে কারণে সকালে অফিসগামী এবং অফিস শেষে ফেরার সময় নগরীর স্টেশনগুলোতে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়।
চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র বিভাগীয় পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) শফিকুজ্জামান ভূঞা বলেন, ‘চট্টগ্রামে নগরী ও জেলা মিলে মোট অনুমোদিত যানবাহনের সংখ্যা ৪ লাখ ২৯ হাজার ১৮৮টি। এরমধ্যে নগরীতে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৯৩৭টি এবং জেলায় ৬৯ হাজার ২৫১টি যানবাহনের অনুমোদন আছে। এসব যানবাহনের মধ্যে নগরীতে ৫০ হাজার ৮৭টি এবং জেলার ২৭ হাজার ৪০৬টিসহ মোট ৭৭ হাজার ৪৯৩টি যানবাহনের ফিটনেস নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীতে বাস-মিনিবাসের অনুমোদন আছে ১ হাজার ১৩০টি; আর টেম্পু ২ হাজার ১৫৮টি, হিউম্যান হলার ৯৬৯টি এবং ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশার অনুমোদন আছে।’
চট্টগ্রাম মহানগর অটোরিকশা-অটোটেম্পু মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিটু চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে গণপরিবহনের তীব্র সংকট আছে। নতুন বাস-মিনিবাস সড়কে নামছে না, বরং কমেছে। হাতেগোনা কয়েকটি রুট ছাড়া বাকিগুলোতে বাস-মিনিবাস চলাচল করছে না। বাস-মিনিবাসের পরিবর্তে এসব রুটে চলাচল করছে হিউম্যান হলার।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীতে অনুমোদনহীন ছোট যানবাহনের সংখ্যাও কম নয়। গণপরিবহন সংকটের কারণে ছোট পরিবহনগুলোর কদর বেড়েছে। নগরীতে অন্তত ২ লাখ রিকশা চলাচল করছে। এর বাইরে ব্যাটারিচালিত টমটম আছে ৪-৫ হাজার, নগরীর ১৬টি থানা এলাকায় অন্তত ৫০ হাজারের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এর বাইরে অনুমোদনহীন সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে অন্তত ১০ হাজার। এসব অনুমোদনহীন যানবাহনের কারণে নগরীতে বাড়ছে যানজট। সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা হারাচ্ছে সড়ক।’
নগরীর আন্দরকিল্লা এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে গণপরিবহন সংকট দীর্ঘদিনের। যেসব পরিবহন আছে, সেগুলো ঠাঁসাঠাসি করে যাত্রী পরিবহন করছে। যে পরিমাণ সিট আছে, তার চেয়ে বেশি দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলা হয়। যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা করছে। যাত্রী নেওয়ার জন্য আছে একই রুটের গাড়ির সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা। সে সঙ্গে আছে টোকেন এবং স্লিপ বাণিজ্যের ঘটনাও।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীতে যানবাহন চলাচলে প্রশাসনের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। যাত্রী বেশি দেখলে ভাড়াও দ্বিগুণ হয়ে যায়। বলা যায়, যানবাহন চালক-হেলপারের কাছে যাত্রীরা সব সময় জিম্মি থাকে। এছাড়া বেশিরভাগ যানবাহন চলাচল করে সুবিধামতো সড়কে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘তিন নম্বর রুটের বাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত যাওয়ার কথা। এরমধ্যে কিছু গাড়ি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলাচল করলেও বাকি গাড়ির মধ্যে কিছু নিউমার্কেট থেকে মুরাদপুর, কিছু ফতেয়াবাদ থেকে অক্সিজেন, কিছু অক্সিজেন থেকে মুরাদপুর, আবার কিছু গাড়ি আছে মুরাদপুর থেকে মার্কেট পর্যন্ত চলাচল করছে। এ কারণে যাত্রীদের বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরীতে বাস-মিনিবাস চলাচলের জন্য ১৭টি রুট নির্ধারণ করা আছে। এসব রুটে এক হাজার ৫৪৫টি গাড়ি চলাচলের সিলিং রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ১৭৫টি গাড়ির রুট পারমিট দেওয়া হয়েছে। তবে বর্তমানে সাড়ে চারশ’টির বেশি গাড়ি এসব রুটে চলাচল করছে না। বাকি গাড়ির মধ্যে কিছু নষ্ট হয়ে আছে। কিছু গাড়ি কল-কারখানায় শ্রমিক আনা-নেওয়াসহ রিজার্ভ ভাড়ায় নিয়োজিত।
সম্প্রতি নগরীর বাস-মিনিবাস রুটগুলোতে কী পরিমাণ গণপরিবহন চলাচল করছে, তার ওপর একটি জরিপ করেছে সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর কর্ণফুলী ব্রিজ থেকে চকবাজার হয়ে কোতোয়ালি মোড় পর্যন্ত এক নম্বর রুট। এ রুটে ১০০টি বাস-মিনিবাস চলাচলের সিলিং নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে ৪৩টি গাড়ির রুট পারমিটও দেওয়া হয়। অথচ কয়েক বছর ধরে এ রুটে একটি বাস-মিনিবাসও চলাচল করছে না। বন্ধ হয়ে আছে রুটটি। ফলে এ রুটে ছোট গাড়ি মাহিন্দ্রা, হিউম্যান হলার, টুকটুকি (টেম্পো) গাড়িই যাত্রীদের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এভাবে গণপরিবহন সংকটে অন্তত পাঁচটি রুট বন্ধ হয়ে গেছে।
বাকি রুটগুলোর মধ্যে কালুরঘাট ব্রিজ থেকে ষোলশহর, প্রবর্তক মোড় হয়ে বিআরটিসি পর্যন্ত দুই নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও ৪৫টি গাড়ির রুট পারমিট দেওয়া হয়। এ রুটটিও গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে জিপিও থেকে পটিয়া হয়ে চন্দনাইশ বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত ১৩ নম্বর রুট। এ রুটে ৩০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও এখনও পর্যন্ত একটি গাড়িরও রুট পারমিট দেওয়া হয়নি। ফলে শুরুই করা যায়নি রুটটি। কয়েক বছর আগে নগরীতে ঘটাও করে উদ্বোধন করা হয় প্রিমিয়ার ট্রান্সপোর্ট নামে এসি বাস সার্ভিস। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে সি-বিচ পর্যন্ত এসি বাস সার্ভিসের ১৪ নম্বর এ রুটে ২০টি গাড়ির সিলিং নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ৪টি গাড়ির পারমিট দেওয়া হয়। এখন সেগুলোও আর চলে না। কুয়াইশ কানেকটিং রোডের মুখ থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ১৬ নম্বর রুট। এ রুটের জন্য ৩০টি গাড়ির সিলিং নির্ধারণ করা হয়। অথচ এখনও চালু করা যায়নি রুটটি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত তিন নম্বর রুটে ১০০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও এ রুটে চলাচল করছে সবগুলো মিনিবাস।
এছাড়া সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত চার নম্বর রুটে ১৫০টি গাড়ির সিলিং এর মধ্যে পারমিট আছে ১৩২টির, চলাচল করে মাত্র ৬০-৬৫টি। বিমানবন্দর থেকে লালদীঘি পর্যন্ত ৫ নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং, সবগুলোরই রুট পারমিট দেওয়া হয়। এ রুটটিও এখন বন্ধ রয়েছে। সি-বিচ থেকে লালদীঘির পাড় পর্যন্ত ৬ নম্বর রুট। এ রুটে ১৫০টি গাড়ির সিলিং এর মধ্যে রুট পারমিট আছে ১৫০টির। চলাচল করে মাত্র ৮০ থেকে ৯০টি। ভাটিয়ারী থেকে বড়পুল, বাদামতলী হয়ে আটমার্সিং পর্যন্ত ৭ নম্বর রুট। এ রুটে ১২৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ১০৭টির, বর্তমানে চলাচল করছে ৫৫-৬০টি গাড়ি।
অক্সিজেন থেকে টাইগারপাস-লালদীঘি পর্যন্ত ৮ নম্বর রুট। এ রুটে ৭৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও রুট পারমিট আছে ৩৯টির, চলছে ১৫-১৬টি গাড়ি। কালুরঘাট থেকে সি-বিচ পর্যন্ত ১০ নম্বর রুট। এ রুটে ২০৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও রুট পারমিট আছে ১৯৭টির, চলছে ১১০-১১৫টি। ভাটিয়ারী থেকে পোর্টকানেকটিং রুট হয়ে সি-বিচ পর্যন্ত ১১ নম্বর রুটে ১২৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ১২৫টির, চলছে ৮০-৮৫টি। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে বহদ্দারহাট হয়ে সি-বিচ পর্যন্ত ১৫ নম্বর রুটে ৫৫টি গাড়ির সিলিং থাকলেও সমপরিমাণ গাড়ির রুট পারমিট আছে। এ রুটে সব গাড়িই চলছে। নিমতলা, বড়পুল হয়ে সীতাণ্ডের বড় দারোগার হাট পর্যন্ত ১৭ রুটে ৩০টি গাড়ির সিলিং থাকলেও পারমিট আছে ২০টির। তবে এ সড়কে রুট পরিবর্তন করে অলংকার মোড় থেকে গাড়ি চলাচল করে। অপরদিকে ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রিজার্ভ স্টাফ বাস চলাচলের জন্য ২০০টি সিলিং নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে রুট পারমিট আছে ৯৩টির।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল বলেন, ‘সড়কে যে পরিমাণ যানবাহনের প্রয়োজন, সেই পরিমাণ নেই। নতুন গাড়িও সড়কে দীর্ঘ দিন ধরে নামছে না। তার ওপর যেসব গাড়ির ইকোনমিক লাইফটাইম ২০ বছর করার কারণে বিআরটিএ এসব গাড়ির ফিটনেস-পারমিট দিচ্ছে না। এ কারণেই অনেক গাড়ি সড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে। আবার করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। বন্ধ থাকার কারণে অনেক গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো মেরামতের সামর্থ্য অনেক মালিকের নেই। এ কারণে এসব গাড়ি স্ক্রাপ হিসেবে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘কোন সড়কে কত যানবাহন চলাচল করছে তা দেখার দায়িত্ব বিআরটিএ’র। সড়কে যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলা হলে সেক্ষেত্রে মামলা দিয়ে জরিমানা করছে ট্রাফিক পুলিশ।’