নাব্যতা সংকটের অজুহাতে ভরা পর্যটন মৌসুমে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌ-রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। যে কারণে হুমকিতে পড়ে পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা। অনিশ্চয়তায় মুখোমুখি হয় দ্বীপের বাসিন্দারা। কক্সবাজার বিমুখ হতে শুরু করে পর্যটকেরা।
নাব্যতা সংকটের মাঝেও কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, বে-ওয়ান ও বার আউলিয়া নামের তিনটি জাহাজ চলছিল ঠিকই। মিয়ানমারের মালবাহী জাহাজ চলাচলও অব্যাহত ছিল। কেবল বন্ধ থাকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ।
এমন বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) ও জাহাজ মালিক সমিতিসহ ১১টি সংগঠন। গত ১০ জানুয়ারি শহরের একটি অভিজাত হোটেলের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনও করেন তারা। এ বিষয়ে পরদিন ১১ জানুয়ারি ঢাকায় বৈঠক হয়।
অনেক দেনদরবার, আবেদন ও বাস্তবতা বিবেচনায় অবশেষে ১২ জানুয়ারি টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন মেলে। আর তাতেই কি কেটে গেল নাব্যতা সংকট! বর্তমানে এ রুটে নির্বিঘ্নে জাহাজ চলছে। আর এতে করে আবারো মুখরিত দ্বীপের বালিয়াড়ি ও সাগরতীর। এতেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে সেন্টমার্টিনে। স্বাভাবিক হয়ে উঠছে পর্যটন ব্যবসা।
সম্প্রতি আবদুল মালেক নামের সেন্টমার্টিনের এক বাসিন্দা নিজের ফেসবুক আইডিতে দুঃখভরা একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি জাহাজ চলাচল প্রসঙ্গে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে। তিনি লেখেন—‘প্রায় ৪ মাস ধরে নাব্যতা সংকট দেখিয়ে জিম্মি করে রেখেছিল এই নৌ-পথ। চিরতরে এই পথ বন্ধ করে রাখার কৌশলে নেমেছে একটি সিন্ডিকেট গ্রুপ। সেই সাথে দেশের পর্যটন শিল্পটাকে গলা টিপে মারছে তারা।’
‘শুক্রবার (১৩ জানুয়ারি) টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ সেন্টমার্টিন জেটিতে ভিড়েছে। যুগযুগ ধরে যে নাফ নদী আর বঙ্গোপসাগর দিয়ে জাহাজ চলতো! ঠিক সেই পথ দিয়েই জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে।’
‘ভিন্ন কোনো সমুদ্র পথ কিংবা নাফ নদী দিয়ে জাহাজ চলছে না। এই নৌ-পথে রাস্তা একটাই।
চারটা মাস ধরে চিৎকার করে করে বলে আসছি.... এই পথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বড়-বড় জাহাজ প্রতিনিয়ত চলছে। আমাদের পর্যটকবাহী জাহাজও চলতে পারবে। কে শুনে কার কথা? মামুর বেটাদের কানে পৌঁছাইতে ৪ মাস সময় লেগেছে।’
‘আমারা বাঁচতে চাই! আমাদের খাবার দিন” ব্যানার হাতে চৌরাস্তার মোড়ে-মোড়ে হাজারো মানুষ দাঁড়িয়েছিলো অসংখ্য বার। তখনও এসি রুমে প্রচণ্ড ঘুমের ঘরে নগ্ন ছিল দাদারা। মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। বিজয় হয়েছে তোফায়েলের (তোফায়েল ভাই)। স্বস্তি ফিরেছে ৩ লাখ অসহায় কর্মজীবী মানুষের। আজ কোথায় গেলো আপনাদের নাব্যতা সংকট? একদম ক্লিয়ার কথা—এটা নাব্যতা সংকট নয়, কর্তা-বাবুদের টাকার সংকট ছিল মাত্র।’
এদিকে, দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস বন্ধ থাকার পর প্রশাসনিক অনুমতিতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। শুক্র ও শনিবার (১৪ জানুয়ারি) এই দুইদিনে চারটি জাহাজে চড়ে সেন্টমার্টিন গিয়েছেন ৯১৪ জন যাত্রী।
শুক্রবার প্রথম দিন ৬১০ জন যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিন ভিড়ে এমভি পারিজাত ও এমভি রাজহংস। শনিবার দ্বিতীয় দিন কেয়ারী সিন্দাবাদ ১৭৪ এবং আটলান্টিক ক্রুজ ৯৮ জন পর্যটকসহ ১৩০ জন যাত্রী নিয়ে টেকনাফ ঘাট থেকে দ্বীপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। অতিথিদের স্বাগত জানান জাহাজ কর্তৃপক্ষ। রোববার (১৫ জানুয়ারি) থেকে আরও দু’টি জাহাজ শহীদ সুকান্ত বাবু ও ভাষা শহীদ সালাম চলাচল করবে বলে জানা গেছে।
দীর্ঘদিন পরে জাহাজ চলাচল করায় দ্বীপবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। স্বাভাবিক ধারায় ফিরেছে পর্যটন ব্যবসা। দেখছে নতুন আশার আলো।
কেয়ারী ট্যুরস অ্যান্ড সার্ভিস লিমিটেডের এজিএম ও হেড অফ ট্যুরিজম এসএম আবু নোমান বলেন, প্রশাসনিক অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষে আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় দমদমিয়া জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে আমাদের জাহাজ ছাড়ে। প্রথম দিনের যাত্রা উদ্বোধন করেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান।
আটলান্টিক ক্রুজের ব্যবস্থাপক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, প্রশাসনসহ সবার সহযোগিতায় দীর্ঘদিন পর আবারো জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। শনিবার ১৩০ জন যাত্রী সেন্টমার্টিন গিয়েছে। সেখানে ৯৮ জন পর্যটক।
তিনি বলেন, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচলের খবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ফোন দিচ্ছে। তারা খুশি। বুকিং দিচ্ছে অনেকে। আমরা পর্যটক সেবায় বদ্ধপরিকর।
জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি-ক্রুজ অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (স্কোয়াব) সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, অনুমতি পাওয়ায় শুক্রবার প্রথম দিন এমভি পারিজাত ও রাজহংস নামের দুটি জাহাজ দমদমিয়া ঘাট থেকে পর্যটক নিয়ে সেন্টমার্টিন যায়। শনিবার কেয়ারি সিন্দাবাদ ও আটলান্টিক ক্রুজ চলাচল শুরু করে। অনুমতি পাওয়া অন্যান্য জাহাজগুলো চলাচল করবে।
তিনি বলেন, পর্যটকদের উন্নতমানের সেবা দিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এক্ষেত্রে ট্যুর গাইডসহ সংশ্লিষ্টরা যথেষ্ট আন্তরিক।
জাহাজ চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার পর কেমন পরিস্থিতি দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, দুইদিনে চারটি জাহাজ গেল। যারা যাচ্ছে তাদের মধ্যে বেশ আনন্দ-উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে। তবে যাত্রী সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কম। প্রচারণা বাড়লে হয়তো আরও বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পরে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসী সন্তুষ্ট। তাদের মাঝে কর্ম-চাঞ্চল্য ফিরেছে।