মরহুম আমিরুজ্জামান (ফকির), পিতা মরহুম আমজাদ আলী, মাতা মরহুমা নয়নজানী। তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ১০নং হাইলধর ইউনিয়নের কুনিরবিল গ্রামের বাসিন্দা । ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে আনোয়ারা উপজেলা থেকে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম এক সাহসী যোদ্ধার নাম আমিরুজ্জামান ফকির। একদিকে মুক্তি বাহিনি হয়ে যুদ্ধে করেছেন রাজাকার, পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরদিকে নিজ গ্রামের সর্দার হিসেবে মুক্তি বাহিনির নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে কুনিরবিল এলাকায় তাঁর নিজ বাড়িতেই অবস্থান করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা, নিজের অর্থ সম্পদ ব্যয় করে মেহমানদারি করেছিলেন মুক্তিবাহিনীদের। অংশ নিয়েছিলেন তিনি বেশ কয়েকটি সম্মুখ যোদ্ধে। তার নেতৃত্বে হত্যা করা হয়েছে বেশ কয়েকজন রাজাকারকে। এমনকি যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও রাজাকারদের আটক করে শাস্তি হিসেবে নিজ গ্রামের রাস্তা তৈরি করিয়েছিলেন সাহসী এই মুক্তিযুদ্ধা। মরহুম আমিরুজ্জামান ফকিরের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়টি জানতে সরেজমিনে তার নিজ গ্রামে গেলে এসব তথ্য জানান তার সহযোগী মুক্তিযুদ্ধারা এবং সমবয়সী সমকালীন স্থানীয়রা। মুক্তিযুদ্ধে এত অবদান সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৫১ বছর পরে এসেও সুষ্ঠু যাচাই বাছায়ের অভাবে চাপা পড়ে যাচ্ছে এই বীরমুক্তিযোদ্ধার ইতিহাস। স্থানীয় বাসিন্দা শামসুল ইসলাম নামের ৬৮ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ বলেন, "আমিরুজ্জামান (ফকির) আমাদের গ্রামের সর্দার ছিলেন, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধারা সবাই আমিরুজ্জামান (ফকির)র বাড়িতে থাকতেন এবং আমিরুজ্জামান (ফকির)সহ সবাই একসাথে বিভিন্ন মিশনে বের হতেন। আমি নিজেও মুক্তিযোদ্ধাদেরর জন্য তিনবার বাজার করে এনেছি।" স্থানীয় আব্দুল আলম নামের সত্তরোর্ধ আরেক বৃদ্ধ বলেন, পরৈকোড়া মাহাতা গ্রামের কমান্ডার ইদ্রীসের নেতৃত্বে হিম্মত শরীফ, সিদ্ধার্ত বড়ুয়া, রনধীর ভট্টাচার্য এবং আমিরুজ্জামান (ফকির)সহ একসাথে তাঁরা যুদ্ধ করেছে। তাহলে বাকিরা মুক্তিযোদ্ধা হলে আমিরুজ্জামান (ফকির) কেন মুক্তিযোদ্ধা হবে না! ৬৫ বছর বয়সী ফরিদুল আলম নামের সাবেক এক ইউপি সদস্য বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে আমিরুজ্জামান (ফকির) একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ওনি এলাকার সরদার ছিলেন আর ভালো মানুষ ছিলেন তাই মুক্তিযোদ্ধাের সনদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি তখন। আর তাঁর নেতৃত্বেই দুর্ধর্ষ রাজাকার আব্দুল হাকিমকে হত্যা করা হয় এটা সবারই জানা। আফজাল আহমদ (৬৯) বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে রাজাকারদের আটক করে তাদের শাস্তি হিসেবে গ্রামের মনসুর আউলিয়া সড়কটি নির্মাণ করায় আমিরুজ্জামান (ফকির)। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির মহা পরিচালক বরাবর দেওয়া পত্র সূত্রে জানা যায়, আমিরুজ্জামান (ফকির) বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ ইদ্রিস (গেজেট নং ৩৭৭৩) এর অধীনে হাবিলদার (অব:) আবু মোহাম্মদ ইসলাম গেজেট (নং- ৪৩৮৯) এর প্রশিক্ষণে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আয়ুব (গেজেট নং- ৪৩৮৬) মোঃ আবদুল গফ্ফার (আইডি নং - ০১১৫০০০১০২০) ও সিদ্ধার্থ বড়ুয়া - (আইডি নং ১১৫০০০৭৭৭১) এবং অন্যান্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন অপারেশনে সরাসরি অংশগ্রহণে বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করেন। এবং আমিরুজ্জামান (ফকির) মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়ে এসব মুক্তিযোদ্ধারা প্রত্যয়নপত্র প্রদান করেন। আমিরুজ্জামান (ফকির) এর ছেলে এডভোকেট মোহাম্মদ হোসেন রোকন জানান, ২০১৪ সালের ২৮শে মে আমার পিতাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি ও তালিকা ভুক্তিকরণের জন্য আবেদন করি। এরই প্রেক্ষিতে বিগত ২০২২ ১৭ই ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক যাচাই-বাছাই করা হলেও জামুকা আইন ২০০২ অনুযায়ী সহমুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে কিংবা স্থানীয়ভাবে সরেজমিনে তদন্ত পূর্বক যাচাই-বাছাই না করে বরং ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে সহমুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে কোনোরূপ তথ্য না নিয়ে শুধু কাগজপত্র জমা নিয়ে আমাদের পরবর্তীতে জানাবে বলে। কিন্তু আজব্দি কোনো খবরাখবর জানাইনি। আনোয়ারা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার (ভারপ্রাপ্ত) বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান বলেন, আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনিতে ছিলাম ওখান থেকেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামে আসি। আর ঐসময় গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করতাম আমরা। তা-ই আমিরুজ্জামান ফকির যেহেতু আমাদের গ্রুপে ছিলেন না তাই আমি ওনার সম্পর্কে তেমন জানিনা। ওনার গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা এবিষয়ে সঠিকটা বলতে পারবেন। এবিষয়ে যুদ্ধাকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ ইদ্রীস বলেন, আমিরুজ্জামান (ফকির) আমাদের গ্রুপে ছিলেন। তিনি শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন একাধারে তিনি একজন সংগঠক, এবং মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষক ছিলেন। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের আর্থিক সহযোগিতা করতেন এবং আমাদের খাবারদাবারের ব্যবস্থা করতেন। তিনি আমাদের সাথে বিভিন্ন রাজাকারকে গ্রেপ্তার করার মিশনে গেছে, আনোয়ারা থানা অপারেশনে গেছে এছাড়াও আরো বিভিন্ন অপারেশনে আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আর বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মান্নান যেহেতু আনোয়ারায় যুদ্ধ করেনি তাই তিনি আমিরুজ্জামান (ফকির) সম্পর্কে জানেন না। আমরা সকল গেজেটভোক্ত মুক্তিযোদ্ধারা চাই আমিরুজ্জামান (ফকির) যেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পায়।