বুধবার (২৩ নভেম্বর) ঘড়ির কাঁটা বেলা ১টা বেজে ৪৭ মিনিট। জেলা জজ আদালত ভবন থেকে নামছে ১৮ জন আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারি। কিছুক্ষণ আগে তাদের সাজা হয়েছে। সেইসঙ্গে ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করেছেন আদালত। এই আত্মস্বীকৃত ইয়াবা কারবারিদের কড়া পুলিশী পাহারায় নেওয়া হচ্ছে কারাগারের উদ্দেশ্য। এ সময় তাদের দেখতে আদালত পাড়ায় প্রচুর মানুষের ভিড়। গণমাধ্যমকর্মীরাও সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন। ওকিল-মুন্সিরা তো আছেনই। ঠিক এমন সময় সবার সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের। অথচ তাদের কারো চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ নেই। দুশ্চিন্তা কিংবা হতাশার লেশমাত্র দেখা যায় নি। দুই বাহু নেড়ে, পা দাবিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সামনে। কয়েকজন হাত উচিয়ে ‘ভি চিহ্ন’ প্রদর্শন করেছে। অপেক্ষমান স্বজনদের দেখে ১ জন তো বলেই দিল, ‘নো টেনশন। শিগগির ফিরছি। কারামুক্ত হয়ে আসছি। দেখা হচ্ছে তোমাদের সাথে। সবাইকে সালাম দিস।’ সাজাপ্রাপ্ত অরেক কারবারি বললো, ‘খুলু (ভাই) কালকে দেখা হবে।’ দণ্ডপ্রাপ্ত ইয়াবা কারবারিদের এমন দম্ভকথা শুনে সবাই ‘থ’ বনে গেছে। অনেকে বলছে, এরা আবারো পুরনো পেশায় ফিরে যাবে না তো! আত্মস্বীকৃত ১০১ ইয়াবা কারবারির প্রত্যেকের দেড় বছর করে কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা ঘোষণার মাধ্যমে শেষ হলো দেশব্যাপী এই মামলাটি। বুধবার (২৩ নভেম্বর) দুপুরে জনাকীর্ণ আদালতে রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। তবে, অস্ত্র মামলায় সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণাকালে কারান্তরীণ থাকা ১৮ আসামি উপস্থিত থাকলেও পলাতক আছেন ৮৩ জন। এ মামলায় আরেক আসামি কারাগারে মৃত্যুবরণ করায় তাকে খালাস দিয়েছেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম। আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, অ্যাডভোকেট মুস্তফা, অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ, অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী, অ্যাডভোকেট সলিমুল মোস্তফা, অ্যাডভোকেট আমিন উদ্দিন প্রমুখ। বুধবার বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে আসামিদের আদালতে আনা হয়। পৌনে ১টা থেকে রায় পাঠ শুরু করেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। রায়ের সব বিষয় উপস্থাপনের পর দুপুর দেড়টার দিকে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এসময় আগে কারাগারে থাকা ১৮ আসামি উপস্থিত থাকলেও বাকি ৮৩ জন অনুপস্থিত ছিলেন। রায়ে সাজা হবে বুঝতে পেরে তারা আগে থেকে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। গত ১৪ নভেম্বর সাক্ষীর জেরা ও ১৫ নভেম্বর সাফাই সাক্ষ্য শেষে ২৩ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেছিলেন জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী টেকনাফ পাইলট হাইস্কুল মাঠে ১০২ জন ইয়াবাকারবারী আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘদিন প্রস্তুতির পর বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু আত্মসমর্পণের পর তাদের কাছ থেকে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার ইয়াবা এবং ৩০ টি দেশীয় তৈরি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে আত্মসমর্পণকারীদের বিরুদ্ধে টেকনাফ মডেল থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনে ওসি (তদন্ত) এবিএমএস দোহা বাদী হয়ে মাদক ও অস্ত্র আইনে পৃথক ২ টি মামলা দায়ের করেন। যার মাদক মামলা নম্বর-থানা : ২৭/২০১৯ ইং, জিআর : ৯৯/২০১৯ ইং(টেকনাফ)। এসটি : ৩৫৪/২০২০ ইং। অস্ত্র মামলা নম্বর : থানা : ২৬/২০১৯ ইং। জিআর : ৯৮/২০১৯ ইং (টেকনাফ), এসপিটি : ৭৩/২০২০ ইং। এদিকে, আত্মসমর্পণের পর প্রত্যেক আসামি এক বছর নয় মাস করে বিনাশ্রম কারাগারে ছিলেন। সে হিসেবে তাদের মাদক মামলার সাজা আর ভোগ করতে হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বিচার সংশ্লিষ্টরা। দেড় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের সাজা ২১ মাস বিনাশ্রমের সঙ্গে সমন্বয় করা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। তবে, আইনি প্রক্রিয়ায় মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে সব আসামিকে কারাগারে যেতে হবে। সেখানে অবস্থানকালে আদালতের রায়ের কপি, জরিমানা সব কিছু উপস্থাপনের পর তারা পূর্ণ মুক্তি পাবেন। এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার (তত্বাবধায়ক) মো. শাহ আলম খান বলেন, যেহেতু তারা আগে কারাভোগ করেছেন সেহেতু সে সময়গুলো সাজার সঙ্গে গণনা হতেই পারে। তবে, এসব বিষয় আদালত রায়ে যেভাবে লিখবেন সেভাবেই গণ্য হবে। তাই রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত সবিস্তারে বলা সম্ভব নয়। আমার তত্বাবধানে এ মামলায় ১৭ জন রয়েছেন।