সম্প্রতি মদের বড় দুটি চালান জব্দ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমস। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন তিনজন। মামলাও হয়েছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে আলোচনায় বন্দরের নিরাপত্তা। জাল ডকুমেন্ট ব্যবহার করে বন্দর থেকে মদের কনটেইনার খালাস নেওয়া হয়। এতে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে মেসার্স জাফর আহমদ নামে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের। ওই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের এক প্রতিনিধির দাবি, তারাও জালিয়াত চক্রের ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন। তাদের লাইসেন্স ব্যবহারের জন্য ভাড়ায় নিয়ে মদের চালান খালাস নেন ছালাউদ্দিন নামে একজন কাস্টমস সরকারের (কাস্টমস হাউজে সিঅ্যান্ডএফের প্রতিনিধি) নেতৃত্বে একটি চক্র।
জানা যায়, ওই লাইসেন্সের স্বত্বাধিকারী মেসার্স জাফর আহমদ নামে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের জাফর আহমদ। ১৯৮৪ সালে এ লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তার ছেলেরা এখন বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করেন।
জাফর আহমদের ছেলে জোবায়ের বলেন, আমার বাবার লাইসেন্স থাকলেও আমাদের আর্থিক সংকট রয়েছে। এ সুযোগে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ম্যাব করপোরেশনের কাস্টমস সরকার মো. ছালাউদ্দিন নিজে কিছু কাজ করার জন্য আমাদের লাইসেন্স ভাড়ায় নিতে চায়। কিন্তু লিখিত ডিট (চুক্তি) করার আগেই ইপিজেডের একটি গার্মেন্টের সুতা খালাসের কথা বলে আমাদের (মেসার্স জাফর আহমদ) নামে ‘সি নম্বর’ (বিল অব এন্ট্রি নম্বর) এন্ট্রি দেন ছালাউদ্দিন। গত ২২ জুলাই সন্ধ্যায় হঠাৎ করে আমাদের বলেন গার্মেন্ট থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, দ্রুত সুতা খালাস নিতে হবে। তখন তাকে চুক্তির বিষয়ে বলা হলে— ছালাউদ্দিন আমাদের বলেন, এখন সময় কম। পার্টি (সুতা কারখানার) সুতা ডেলিভারি দিতে বলছে। এখন কনসাইনমেন্টটি খালাস নেওয়ার পর শনিবার সকালে বসে ডিট করবেন।
‘এসময়ের মধ্যে ডিটের টার্ম অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো তৈরি করে নিতে বলেন ছালাউদ্দিন। এরপর শুক্রবার সন্ধ্যায় কনটেইনার দুটি খালাস হয়। রাত ৯টার পর থেকে আমাদের ফোনে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ, কাস্টম থেকে ফোন আসা শুরু করে। রাত ৯টার আগ পর্যন্ত ছালাউদ্দিনের সঙ্গে অসংখ্যবার কথা হয় আমাদের। এর মধ্যে কাস্টম থেকে আমাদের ডাকা হয়। আমরা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী সিঅ্যান্ডএফ মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি অবগত করি। তারা (শুভাকাঙ্ক্ষী) আমাদের আপাতত কাস্টমে না যেতে পরামর্শ দেন। এর মধ্যে রাতেও ছালাউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি আমাদের বলেন, সামান্য ঝামেলা হয়েছে, আমরা ডকুমেন্ট নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছি। সকালে সব সমাধান হয়ে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, রাত আড়াইটার পর থেকে ছালাউদ্দিনের মোবাইল বন্ধ পাই। এরপর থেকে তার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি। শনিবার (২৩ জুলাই) সকালে জানতে পারি নারায়ণগঞ্জে দুই কনটেইনার মদের চালান জব্দ করা হয়েছে। কনটেইনার দুটি খালাসে আমাদের লাইসেন্স ব্যবহার করা হয়েছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের প্রতিনিধি এসব দাবি জানালেও আইন অনুযায়ী তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মো. ছালাউদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাস্টম থেকে ২০১৯ সালের ২০ মে মো. ছালাউদ্দিনকে কাস্টমস সরকারের পারমিট অর্ডারও দেওয়া হয়। যার নম্বর- এন ৩১৭/১৯। ঠিকানা দেখানো হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এলাকা। ছালাউদ্দিনের কর্মস্থল প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়- ম্যাব করপোরেশন। কাস্টমস লাইসেন্সে ম্যাব করপোরেশনের ঠিকানা দেওয়া আছে- চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ ১৬৯৩ শেখ মুজিব রোডের জাকির ম্যানশনের চতুর্থ তলায়।
বুধবার (২৭ জুলাই) সন্ধ্যায় কথা হলে ম্যাব করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মো. নুরুল আবছার বলেন, ‘আমি আমার লাইসেন্সটি (ম্যাব করপোরেশন) বিক্রি করে দিয়েছি। তবে এখনো নাম পরিবর্তন হয়নি। লাইসেন্স বিক্রির আগে ছালাউদ্দিন কয়েক মাস আমার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। গত কয়েকদিন ধরে তার মোবাইল বন্ধ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এখন শুনছি তাকে পুলিশ খুঁজছে।’
আইপি জাল করে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা মদের চালান খালাস নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনায় গত পাঁচদিনে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বন্দর থেকে ৪০ ফুটের কনটেইনার দুটি জাল-জালিয়াতি করে খালাসের পর বন্দর বেরিয়ে গেলে কাস্টমসের তৎপরতায় নারায়ণগঞ্জে র্যাবের সহযোগিতায় জব্দ করা হয়। এরপরের দুদিনে বন্দর অভ্যন্তর থেকে জব্দ করা হয় আরও তিন কনটেইনার মদ। জব্দ হওয়া মদের পাঁচটি চালানই কুমিল্লা, ঈশ্বরদী, নীলফামারীর উত্তরা এবং বাগেরহাটের মোংলা ইপিজেডে চার শিল্প প্রতিষ্ঠানের আইপি জালিয়াতি করে আমদানি করে জালিয়াত চক্র।
জব্দ হওয়া সেই পাঁচ চালানের দুটি খালাস হয় মেসার্স জাফর আহমদ নামের সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের নামে। আরেকটি খালাসের জন্য কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রিও দাখিল করে একই সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। তবে শেষ দুই চালানে কাস্টমসের এসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করায় দালিলিকভাবে কোনো সিঅ্যান্ডএফ খালাসের জন্য দায়িত্বে ছিল তা জানা যায়নি। তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধারণা শেষ দুটি চালানও আগের একই জালিয়াত চক্র আমদানি করেছে।
২২ জুলাই রাতে দুই কনটেইনার মদ জব্দের ঘটনায় তিনজনকে আটক করে র্যাব। ২৪ জুলাই (রোববার) রাতে আটক তিনজনসহ ১১ জনকে এজাহারনামীয় আসামি করে র্যাব-১১ এর উপপরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে সোনারগাঁও থানায় মামলা করেন।