বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত দুই বছর মন্দা গেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। দেশে দেশে কঠোর বিধিনিষেধে ব্যাহত হয়েছে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য। ভাটা পড়েছিল আমদানি-রপ্তানিতে। করোনার অভিঘাত ছায়া ফেলে ঈদ আনন্দেও। দোকানপাট, শপিংমলসহ বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে খোলা থাকলেও গত কয়েক ঈদে সংক্রমণ-ভীতির মধ্যে ঈদ বাজারে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না। তবে এবারের চিত্রটা ভিন্ন। দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি শিথিল হওয়ায় জীবনযাত্রায় ফিরেছে স্বাভাবিক ছন্দ। মন্দাকাল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যও।
এরই ধারাবাহিকায় ঈদুল ফিতর সামনে রেখে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে আগেভাগেই জমজমাট ঈদ বাজার। শুক্রবার (৮ এপ্রিল) ছুটির দিনে সে দৃশ্য আরও স্পষ্ট। নগরীর বিভিন্ন বিপণী বিতানসহ মার্কেটগুলোতে ছিল ক্রেতাদের বাড়তি ভিড়। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর তুলনায় বেচাকেনাও ছিল বেশ ভালো। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।
এদিন ঈদ ঘিরে বন্দরনগরীর মার্কেটগুলোতে অনেককেই পরিবার-পরিজন নিয়ে আসতে দেখা গেছে। বাজারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাধারণ ক্রেতার উপস্থিতি। নগরীর বড় বড় মার্কেট ও অভিজাত শপিংমলগুলোতে ক্রেতাদের জটলা চোখে পড়ে। ঈদ যত ঘনাবে কেনাকাটায় ভিড় তত বাড়বে, এ বিষয়টি মাথায় রেখেই কেউ কেউ আগেভাগে প্রয়োজনী কেনাকাটা সেরে রাখছেন। আবার ঈদে নতুন কী কী পোশাক এসেছে, তা-ও দেখতে আসছেন অনেকে। নগরীর রিয়াজ উদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেইন, টেরিবাজার, জহুর হকার মার্কেটেও ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। তবে গত দুই বছরের মতো এবার স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সরকারি কোনো কঠোরতা দেখা যায়নি।
রমজানের প্রথম সপ্তাহেই থান কাপড়, রেডিমেড কাপড় ও জুতোর দোকানগুলোতে বেশি ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া মার্কেট ও বিপণীকেন্দ্রগুলোর বাইরেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টেইলার্সগুলোতেও হুমড়ি খাচ্ছেন অনেকে। সেলাই কারিগররা বলছেন, ঈদের সময় যত সামনে আসছে তাদের ব্যস্ততা তত বাড়ছে। অনেক অর্ডার রয়েছে। সবাইকে যেন সময়মতো ডেলিভারি দেওয়া যায় সেজন্য এখন দিনরাত কাজ করছেন তারা। আবার রমজানের এক সপ্তাহ না যেতেই নামিদামি অনেক টেইলার্স নতুন অর্ডার নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
দুপুরে সরেজমিনে নগরীর টেরিবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, জুমার নামাজের পর থেকে লোকজন মার্কেটে ভিড় করছেন। জামা কাপড়ের জন্য চট্টগ্রামে অনেক প্রসিদ্ধ টেরিবাজার। একসময় কাপড়ের পাইকারি বাজার হিসেবে সুখ্যাতি থাকলেও সময়ের ব্যবধানে খুচরা কেনাকাটার জন্যও টেরিবাজার সুনাম কুড়াচ্ছে। কাপড়ের পাইকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সময়ের বিবর্তনে স্থান করে নিচ্ছে আধুনিক শপিংমল ও মেগাশপগুলো। তীব্র গরম থেকে ক্রেতাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে পাল্লা দিয়ে লাগানো হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র। নগরীতে অন্যান্য অনেক আধুনিক মার্কেট ও বিপণী বিতান থাকলেও ক্রেতারা এ মুহূর্তের জন্য হলেও ঢু মারেন টেরিবাজারে। বছরজুড়ে বেচাকেনা যেমনই হোক, ঈদের আগে টেরিবাজারে পড়ে কেনাকাটার ধুম।
সেখানকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাড়ি, থ্রি-পিস, শাটিং স্যুটিং কাপড়ের জন্য আধুনিক শপিংমল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এরমধ্যে পরশমণি, মেগামার্ট, মল-২৪, ভাসাভি, মনে রেখ, বৈঠক বাজার, মৌচাক, বড় বাজার, নিউ রাঙ্গুলি, মাসুম ক্লথ, রাজপরী, রাজস্থান, জারা, সানা ফ্যাশন মল, জাবেদ, মাহমুদিয়া, স্টার ট্রেডিং, আলো শাড়িজ ক্রেতাদের বাড়তি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এগুলোর বেশিরভাগই ‘এক দাম’র দোকান।
ব্যবসায়ীরা জানান, টেরিবাজারে ছোটবড় প্রায় ৮৫টি মার্কেট রয়েছে। এখানে দোকানের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।
শুক্রবার বিকেলে টেরিবাজারের বড় কাপড়ের দোকান নিউ রাঙ্গুলির স্বত্বাধিকারী মো. আজম বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে একেবারে ব্যবসা হয়নি বললেই চলে। কিন্তু এবার বেচাকেনায় স্বাভাবিকতা আসতে শুরু করেছে। অনেকে আগেভাগে কেনাকাটা সেরে ফেলছেন। সব বয়সী লোকজনই মার্কেটে আসছেন।
চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ পরিবারের সবাইকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছেন টেরিবাজারে। তিনি বলেন, রমজান যতই এগোবে মার্কেটগুলোতে লোকজনের ভিড় বাড়বে। এতো ঠাসাঠাসির মধ্যে আরামে কেনাকাটা করা যায় না। তাই এবার একটু আগেভাগে এসেছি। তবে কাপড়ের দাম অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে।
অন্যদিকে সুঁইসুতা থেকে শুরু করে পোশাক, ভোগ্যপণ্য, তৈজসপত্র, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, প্রসাধন, জুয়েলারি সব ধরনের কেনাকাটায় রিয়াজ উদ্দিন বাজারও খুব জনপ্রিয়। ১২০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী এ বাজারে সবকিছুই পাওয়া যায়। কম দামে ভাল পণ্যের জন্য ক্রেতাদের পছন্দের বাজার এটি। ঈদ ঘিরে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় এ বাজারে ধনী-গরিব সব শ্রেণির ক্রেতার মেলবন্ধন ঘটে। সময়ের বিবর্তনে বন্দরনগরীতে অনেক নামিদামি মার্কেট-শপিংমল গড়ে উঠলেও রিয়াজউদ্দিন বাজার যেন এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী। পাইকারি থেকে খুচরা- কেনাকাটায় সব শ্রেণির ক্রেতা এখানে আসেন। নগরীর আশপাশের অনেক এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে এখান থেকে পাইকারি দামে তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে যাবতীয় পণ্য কিনে নেন।
রিয়াজ উদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, বিগত দুই বছর ব্যবসায়ীরা এক প্রকার সংকটকাল কাটিয়েছে। দুই বছরের স্থবিরতা কাটিয়ে এবার ব্যবসায় কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরেছে। এবার রমজানের শুরু থেকে ঈদের বেচাকেনা শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীদের মাঝেও স্বস্তি ফিরছে। বেচাকেনাও বেশ ভালো।
রিয়াজউদ্দিন বাজার ও টেরিবাজার ছাড়াও নগরীর বিপণী বিতান, চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্স, সানমার ওশ্যান সিটি, ফিনলে সেন্টার, আমিন সেন্টার, ভিআইপি টাওয়ার, মিমি সুপার মার্কেট, আফমি প্লাজা, আখতারুজ্জামান সেন্টারেও ছুটির দিনের বিকেলে ছিল ক্রেতাদের সরব উপস্থিতি। নিউ মার্কেটের (চট্টগ্রাম বিপণী বিতান) চিত্রও ছিল একইরকম।
জেন্টেল পার্ক’র সেলসম্যান সৌরভ বলেন, রমজানের এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই ঈদের কেনাবেচা বাড়ছে। তবে বছরজুড়েই আমাদের মার্কেট (বিপণী বিতান) শুক্রবার বন্ধ থাকে। ঈদ উপলক্ষে খোলা রাখার বিষয়টি ক্রেতারা এখনো হয়তো জানেন না। যে কারণে এখানো কেনাবেচা কিছুটা কম।
চট্টগ্রাম বিপণী বিতান ওয়েল ফেয়ার কমিটির সভাপতি মো. ছগীর বলেন, ঈদ উপলক্ষে শুক্রবারও বিপণী বিতান খোলা রাখা হয়েছে। রমজানের প্রথম দু-চারদিন বেচাকেনা একটু কম হলেও আজ (শুক্রবার) ক্রেতার উপস্থিতি অনেক বেড়েছে। বেচাকেনাও আগের চেয়ে ভালো।
আগ্রাবাদ আখতারুজ্জামান শপিং কমপ্লেক্সের সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে বিগত দুই বছর তেমন ব্যবসা হয়নি। এবার করোনার ধাক্কা সামলে মার্কেটের দোকানিরা নতুন নতুন কালেকশন এনেছেন। রমজানের শুরু থেকেই ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়েছে। এখন থান কাপড়, ছোটদের কাপড়, জুতো বেশি চলছে। বিশেষত নন-স্টিচ কাপড় বেশি বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি সালেহ আহমদ সুলেমান বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে ব্যবসায় মন্দা ছিল। এখন করোনার প্রাদুর্ভাব কমেছে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম অনেক চড়া। এর প্রভাব ঈদ বাজারে পড়তে পারে। তারপরেও গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়েছে। অনেকে নতুন করে পুঁজি সংগ্রহ করে ব্যবসা চালাচ্ছে। আশা করছি, এবার ব্যবসায়ীরা ঈদ ঘিরে লাভের মুখ দেখবেন।
তবে রমজানের শুরু থেকে নগরীতে যানজট তীব্র আকার ধারণ করায় ঈদের কেনাকাটার জন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সাধারণ ক্রেতারা ভোগান্তিতে পড়ছেন, বলেন সালেহ আহমদ।