অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ‘সহায়ক শক্তি’ হলেও বিএনপির সামনে অগ্নিপরীক্ষা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও নতুন ভিসা নীতি, বিদেশিদের বক্তব্য-বিবৃতিসহ নানা কৌশলে যতই ‘চাপ’ সৃষ্টি করুক না কেন– মাঠে শক্তি দেখাতে হবে বিএনপিকেই। উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমনটি মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির নীতিনির্ধারক নেতারা। তাঁদের মতে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে বিএনপিকে চলমান আন্দোলনে ব্যাপক জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথ দখলের মধ্য দিয়েই দাবি আদায় করতে হবে টানা তিনবার ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটিকে। বিশেষ করে সমমনা দলগুলোকে নানা ‘প্রলোভনের’ ঊর্ধ্বে রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে।
একই সঙ্গে বিশ্লেষকরা মনে করেন, আন্দোলন ও নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ ভূমিকা পালনের জায়গায় আনার চেষ্টা করতে হবে দলটিকে। আবার সরকারের পক্ষে চীন-রাশিয়ার পর নতুন করে প্রভাবশালী প্রতিবেশী ভারতও ‘সক্রিয়’ হলে নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরূকরণের শঙ্কা রয়েছে। সর্বোপরি দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের মতো সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী দলকে রাজপথে মোকাবিলা করে ‘সফল’ গণআন্দোলন গড়াই বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান তাঁরা।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল শনিবার বলেছেন, বিদেশিদের কোনো চাপের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। গণতান্ত্রিক দেশগুলো বিভিন্ন দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিপক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে থাকে; বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা-ই করছে। আমরা নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছি। বিদেশিরা কে কী বলল, না বলল– সেটি আমাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে আছি। সেই আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে দাবি আদায়ে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলাই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে আমাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বিপুলসংখ্যক জনগণ সাড়া দিচ্ছে। মানুষ নিজেদের মৌলিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে জেগে উঠেছে। আমরা আশা করি, অচিরেই এক দফা আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে পারব।’
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদেশিদের চাপ অবশ্যই সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। অনেক সময় বিদেশিদের চাপে সরকারের নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে পরস্পরের শর্ত অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল বিএনপিও এর সুফল পেতে পারে। তবে তাদের মাঠের শক্তিও দেখাতে হবে।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারী ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ভিসা না দিতে মার্কিন নতুন ভিসা নীতি ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেছে সবাই। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ প্রশাসন সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। অবশ্য বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ছয় কংগ্রেসের চিঠি, আসন্ন বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় কংগ্রেসের চিঠিকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছে রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। একই সঙ্গে নিজেদের দাবির সপক্ষে বিদেশিদের এসব চাপ আসাতে খুশি দলটির নেতাকর্মীরা। সুষ্ঠু নির্বাচনে বন্ধু রাষ্ট্রের চাপ দাবি আদায়ে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তাঁরা। তবে রাজপথেই ফয়সালার মাধ্যমে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করতে হবে বলে জানান নেতারা।
অন্যদিকে, বিদেশিদের এসব তৎপরতাকে প্রকাশ্যে ‘আমলে’ নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে পর্দার আড়ালে ভিন্ন চিত্র। নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা, লবিস্ট নিয়োগ ও বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে দলটি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে দীর্ঘ ১০ বছর পর প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তও বিদেশিদের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে। আবার কারও চাপে মাথানত না করার কথাও বলছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী।
পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এও বলছেন, ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে কাছে টানার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে। আগামী নির্বাচন ঘিরে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। ভূ-রাজনীতির খেলোয়াড়রা ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে। মার্কিন ও ইইউর কংগ্রেসম্যানদের বিবৃতিও নিজেদের স্বার্থেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারও মনে করে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নানাভাবে আস্থায় আনার চেষ্টা করছে সরকার। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা বেকায়দায় পড়ে নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে হচ্ছে সরকারকে। এতে কিছুটা হলেও রাজনৈতিক ‘সুবিধা’ পেতে পারে রাজপথের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারা এবং সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি। তবে বিএনপি জামায়াত ব্র্যান্ডিং থেকে কিছুটা বেরিয়ে বাম-ডান সমমনা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এখনও নতুন কোনো মিত্র নেই। তবে জাতীয় পার্টি ও ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে নতুন জোট করার চেষ্টা করছে তারা।
আবার আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে ইঙ্গিত করে মুখ খুলেছে চীন ও রাশিয়া। প্রকাশ্যে ভারত এখনও কিছু না বললেও অচিরে ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠতে পারে প্রভাবশালী দেশটিও। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বিশেষ করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে মহাজোটে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই ভারত এখন পর্যন্ত নীরব। চীন, ভারত ও রাশিয়ার বলয় দৃশ্যমান হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণ ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্রিকসে যোগদানের ঘোষণাও দিয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে দুই পরাশক্তি বাংলাদেশ ইস্যুতে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। একদিকে তারা সংবিধানের অধীনেই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের পক্ষে কথা বলবে, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানকে জোরদার করবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি সংবিধানের বাইরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলতে পারবে না। তাতে বিএনপির নির্দলীয় সরকারের পক্ষে প্রকাশ্যে বিদেশি কোনো শক্তি কৌশলগত কারণে সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের কথা বলতে পারবে না। এ পরিস্থিতিতে রাজপথই একমাত্র সমাধানের পথ বিএনপির। এটাই বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারকরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক বড় দেশ ও সংস্থাগুলো সব সময়ই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে আসছে। বাংলাদেশের বিগত দুটি নির্বাচনের চিত্র দেখে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে তারা আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিষয়টি নির্যাতিত ও ভোটাধিকার হারা মানুষ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সামনে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে রাজপথেই সব ফয়সালা করবেন বলে জানান তিনি।
বিএনপি নেতারা জানান, রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলার পথেও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গত ১৫ বছরে দুটি নির্বাচনকেন্দ্রিক আন্দোলনসহ নানা ইস্যু মোকাবিলায় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে ক্ষমতাসীন দল। বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গণগ্রেপ্তার, গায়েবি মামলা, পুরোনো মামলায় হয়রানি ও নির্যাতন চলমান। এ পরিস্থিতিতে দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও জনগণকে চূড়ান্ত আন্দোলন পর্যন্ত নানা অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করে রাজপথে রাখতে হবে। আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনে ‘সবাই’ আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে গেছেন।
দলটির নেতাদের মতে, সফল আন্দোলন গড়তে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে আনতে হবে। যেমনটি আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করেছিল। বর্তমানে প্রশাসনের কাছ থেকে সেই ধরনের সমর্থন আদায় করা কঠিন। তারপরও নানাভাবে চেষ্টা করছেন তাঁরা। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরাসরি পক্ষে আনতে না পারলেও ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে বিএনপি। বিষয়টি তাদের জন্য খুব সহজ নয় বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
দলীয় সূত্র জানায়, নতুন মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আন্দোলনকে সফল করাই বিএনপির জন্য অগ্নিপরীক্ষা। ইতোমধ্যে সমমনা দলগুলোকে সরকারের দিক থেকে নানা প্রলোভন ও আসন দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে। এতে সমমনা দলগুলোকে চূড়ান্ত আন্দোলনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখাও কঠিন চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে সমমনা দলগুলোর শরিকরা বিভিন্ন স্থানে গোপন বৈঠকেও মিলিত হচ্ছে। ওইসব বৈঠককে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। ইতোমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে ড. রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদ বেরিয়ে যাওয়াকেও সরকারের তৎপরতার অংশ হিসেবে দেখছে বিএনপি।