একজনের বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে করেন মালির চাকরি, অন্যজনের বাবা প্রহরী। আরেকজনের বাবা গাড়ি চালক। এক বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলেকে বিবিএস ক্যাডার বানানো। আরেক বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
বাবাদের সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে গেছে। ছেলেরা হয়েছে বখাটে। নারী নির্যাতন মামলায় তারা এখন জেলহাজতে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িত পাঁচ শিক্ষার্থীর এমন পরিণতিতে জন্মদাতাদের কষ্টের শেষ নেই।
তারা হলেন- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র মো. আজিম, হাটহাজারী কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ১ম বর্ষের ছাত্র মো. নুর হোসেন শাওন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ ২য় বর্ষের ছাত্র মো. নুরুল আবছার বাবু, হাটহাজারী কলেজের অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র মো. মাসুদ রানা ও বখাটে সাইফুল ইসলাম।
ছাত্রী হেনস্তায় অভিযুক্ত আজিম নোয়াখালীর হাতিয়া থানার চর ভারত সেন এলাকার মো. আমির হোসেনের পুত্র। নুর হোসেন শাওন হাটহাজারীর ফতেপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের জাবেদ হোসেনের ছেলে। নুরুল আবছার বাবু ফেনীর পরশুরাম বেড়াবাড়ি এলাকার বেলায়েত হোসেনের ছেলে। মাসুদ রানা ঝালকাঠির আশিয়ার এলাকার আবদুল মান্নানের ছেলে। সাইফুল ইসলামের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়।
এই চক্রের হোতা আজিম হোসেনের বাবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী। বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন ইসলামিয়া কলোনিতে তাদের বাসা। আজিমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ওই কলোনিতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই চুরি, ছিনতাই, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০২০ সালে ছিনতাই ও বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে আজিম জেল খাটে। সে নিজেকে এলাকার স্থানীয় নেতা হিসেবে পরিচয় দিতো। বোটানিক্যাল গার্ডেন বা পুকুর পাড় এলাকায় কোনো ছাত্র/ছাত্রী বসলেই অশ্লীল মন্তব্য করতো। তার নেতৃত্বেই সেখানে গড়ে ওঠে অপরাধী চক্র। তারাই বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত। আজিমকে চবি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সাইফুল ইসলাম। তাকে বখাটে সাইফুল নামে চিনেন সবাই। বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হয়েও পড়ালেখা চালিয়ে নিতে পারেনি। বাবার কাছ থেকে কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা বলে কয়েক দফা টাকা নিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করেছে সাইফুল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ ২য় বর্ষের ছাত্র মো. নুরুল আবছার বাবু এই গ্রুপে সম্পৃক্ত হয়ে অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দফতরে চাকরি করেন। চেষ্টা করছিলেন সন্তানকে মানুষ করতে। কিন্তু মেধাবী বাবু নেশাগ্রস্ত হয়ে ক্যাম্পাসে অপকর্ম করে বেড়িয়েছে। গ্রেফতার হওয়ার পর র্যাব হেফাজতে থাকার সময়ও তাকে হাস্যেজ্জ্বল দেখা গেছে। চবি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাবা বলেন, ‘নিজের জীবনের সব কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে ছেলেকে মানুষ করার চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু আমি ব্যর্থ। নিজের জন্য কিছুই করিনি। সব করেছি সন্তানের জন্য। যখন যা চেয়েছে তখন তা-ই দিয়েছি। এরপরও ছেলে যদি এমন করে, বাঁচতে ইচ্ছে করে না’।
গত ১৭ জুলাই রাত ১০টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হল সংলগ্ন এলাকায় ৫ জন ছাত্রের হাতে শারীরিক হেনস্তার শিকার হন এক ছাত্রী। ওই সময় তার সাথে থাকা বন্ধু বাধা দিলে তাকেসহ ওই ছাত্রীকে মারধর করে বখাটেরা। এ সময় তাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ছাত্রীকে ওই জায়গা থেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ ও হাটহাজারী থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। গত কয়েকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনার বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। ২২ জুলাই রাতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে ৫ জনকেই গ্রেফতার করে র্যাব। পরে নারী নির্যাতন মামলায় তাদেরকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।