দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হয় সমুদ্রপথে। এরমধ্যে ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রধান এ সমুদ্রবন্দরে বাড়ছে ব্যস্ততা। জরিপ বলছে, ২০১৮ থেকে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটবে। ২০৩০ সাল নাগাদ এ বন্দর দিয়ে হ্যান্ডলিং হবে ৪০ লাখ টিইইউস (টুয়েন্টি ফুট ইক্যুয়েভেলেন্ট ইউনিট) কনটেইনার। ২০৪৩ সালে তা উন্নীত হবে ৫৬ লাখ টিইইউসে। তবে বন্দরে চাপ ও ব্যস্ততা বাড়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা আমদানিপণ্য খালাসে ফাঁকফোকরের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনুসন্ধানে মিলেছে নানা অসঙ্গতি ও অনিয়ম।
সদ্যবিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টিইইউস কনটেইনার এবং ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার মেট্রিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে। সাধারণত, আমদানি পণ্য বন্দর থেকে খালাস করতে কিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিদেশি মদের চালান বের হওয়া এবং বহির্নোঙর থেকে বাল্কপণ্য খালাস নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক সামনে এসেছে।
কাস্টমস, আমদানিকারক, পণ্য খালাসকারী সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং) প্রতিষ্ঠান ও লোকাল শিপিং এজেন্টসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমদানিপণ্য দেশের সমুদ্রসীমায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে খালাসের প্রথম ধাপের কাজটি শুরু করেন পণ্য নিয়ে আসা জাহাজের ক্যাপ্টেন। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, জাহাজ বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশের আগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পণ্যের আইজিএম (ইমপোর্ট জেনারেল ম্যানিফেস্ট) কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে সাবমিট করতে হয়।
আইজিএম হচ্ছে আমদানিপণ্যের তথ্য সম্বলিত তালিকা। যেখানে পণ্যবাহী জাহাজের নাম, রোটেশন নম্বর, আমদানি-রপ্তানিকারকের নাম-ঠিকানা, পণ্যের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, পণ্যের পরিমাণ ও গন্তব্য ইত্যাদি তথ্য থাকে। এরপর জাহাজ বন্দরে বার্থিং করার পর বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে কনটেইনাগুলো বন্দর বার্থে নামে। এরপর বেসরকারি অফডকে (বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো বা আইসিডি) খালাসযোগ্য পণ্য হলে স্ক্যানিং হয়ে কনটেইনারগুলো অফডকে চলে যায়।
দ্বিতীয় ধাপে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা ও শুল্কায়ন করতে হয়। বন্দরে পণ্যভর্তি কনটেইনার নামার পর এবং রপ্তানিকারক থেকে শিপমেন্ট নথি পাওয়ার পর অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে বিল অব এন্ট্রি (সি নম্বর) সাবমিট করেন আমদানিকারক প্রতিনিধি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট। এরপর পণ্য চালানে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বিশেষ কোনো পর্যবেক্ষণ না থাকলে কাস্টমস হাউজে পণ্যের শুল্কায়ন হয়। শুল্ক নির্ধারিত হওয়ার পর অ্যাসেসমেন্ট নোটিশের মাধ্যমে ব্যাংকে শুল্ক কর পরিশোধ করেন আমদানিকারক। এরপর কাস্টমস থেকে পণ্য ছাড়ের অনুমতি দেওয়া হয়। বন্দরের যাবতীয় ফি পরিশোধ শেষে বন্দর অভ্যন্তরে থাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে আমদানিপণ্য খালাস নেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে পণ্যের চালানে পর্যবেক্ষণ থাকলে বা সি নম্বর লক থাকলে কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধি ও আমদানিকারকের প্রতিনিধিসহ অন্য প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়। কায়িক পরীক্ষার প্রতিবেদনসহ পরবর্তীসময়ে কাস্টমসে নথি উপস্থাপন করা হলে সে অনুযায়ী শুল্কায়ন করে কাস্টমসের পণ্য ছাড়ের প্রক্রিয়া শেষ করে খালাসের পদক্ষেপ নিতে হয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে। এক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রিতে ঘোষণা দেওয়া পণ্যের সঙ্গে কায়িক পরীক্ষায় মিল থাকলে স্বাভাবিক শুল্কায়ন শেষে পণ্য ছাড় হয়। যদি ঘোষিত পণ্যের সঙ্গে কায়িক পরীক্ষায় মিল না থাকে তবে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ফাইন পেনাল্টিসহ শুল্কায়ন শেষে পণ্য ছাড় দেওয়া হয়। বেআইনি পণ্য হলে আমদানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আবার আমদানিপণ্য বন্দরে আসার পর আমদানিকারক পণ্য খালাস না নিলে বা মামলা জটিলতা না থাকলে নির্ধারিত সময়ের পর পণ্য নিলাম ও ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে আমদানি পণ্য শিল্পকারখানার ক্যাপিটাল মেশিনারিজ হলে আমদানিকারক জাহাজে আসা কনটেইনার সরাসরি নিজের কারখানায় নিয়ে যেতে পারেন। এ পদ্ধতিকে বক্স ডেলিভারি বলা হয়। এক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি ছাড়াও বন্দর ত্যাগের আগে পণ্যভর্তি কনটেইনার বাধ্যতামূলকভাবে স্ক্যানিং করা হয়। অফডক থেকে পণ্য খালাসের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের।
এছাড়া শতভাগ রপ্তানিমুখী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর (ইপিজেড) কারখানাপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পান উদ্যোক্তারা। সাধারণ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানিকারককে ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে হলেও ইপিজেড কারখানাগুলোর পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে হয় না। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটির (বেপজা) আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) সুবিধা নিয়ে পণ্য আমদানির সুযোগ রয়েছে ইপিজেড কারখানার। এজন্য তাদের কোনো শুল্ককরও দিতে হয় না।
এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আইপি জালিয়াতি করে সম্প্রতি অবৈধভাবে বিদেশি মদের চালান আমদানি করে জালিয়াতচক্র। এরমধ্যে মদবাহী দুটি কনটেইনার বন্দর থেকে খালাস হয়। বাধ্যবাধকতা থাকলেও কনটেইনার দুটি স্ক্যানিং করা হয়নি। জাল স্ক্যানিং দেখিয়ে বন্দর থেকে বের করে নেওয়া হয় কনটেইনারগুলো। পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরে দ্রুত র্যাবের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থেকে মদভর্তি কনটেইনার দুটি জব্দ করে। বিষয়টি গণমাধ্যমের খবরে এলে দেশজুড়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়।
গত ২২ জুলাই দিনগত রাতের এ ঘটনার পরবর্তী তিনদিনে বন্দর থেকে আরও তিনটি মদের কনটেইনার জব্দ করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, সুতা, মেশিনারি ও শিল্পের কাঁচামাল ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা পাঁচটি চালানে ৭৭ হাজার লিটার মদ ছিল। এতে প্রায় ৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা করেছিল জালিয়াতচক্র। একইসঙ্গে দেশি টাকাও বিদেশে পাচার করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালটেন্সির মাধ্যমে বন্দরের জন্য একটি জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ থেকে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ঘটবে। জরিপ অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ এ বন্দর দিয়ে ৪০ লাখ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হবে। ২০৪৩ সালে তা উন্নীত হবে ৫৬ লাখ টিইইউসে।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৩ টিইইউস। গত অর্থবছরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছিল ১১ কোটি ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৩ মেট্রিক টন। একই সময়ে ১৬৯টি জাহাজ বেশি হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কনটেইনার, কার্গো, ট্যাংকার মিলে ৪ হাজার ২৩১টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আগের অর্থবছরে হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৪ হাজার ৬২টি জাহাজ। সব মিলিয়ে এ তিন পর্যায়ে প্রবৃদ্ধিও হয়েছে।
কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের মধ্যে একটি অংশ বন্দরের জেসিবিতে (জেনারেল কার্গো বার্থ) সম্পন্ন হলেও বড় অংশটির পণ্য খালাস হয় বহির্নোঙরের মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ দিয়ে। পরে এসব লাইটারেজ আমদানিকারকের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যায়। বন্দর থেকে কনটেইনার খালাসের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়, কার্গোর ক্ষেত্রে তা কিছুটা ভিন্ন। কার্গোবাহী জাহাজ বহির্নোঙরে আসার পর কাস্টমস ও আমদানিকারকের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাহাজে কী পরিমাণ পণ্য এসেছে তা যৌথ সার্ভে করা হয়। সার্ভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুল্কায়ন শেষে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পণ্য ছাড়ের অনুমতির পর মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে পণ্য খালাস শুরু হয়। এতে কিছু ক্ষেত্রে বহির্নোঙরে জাহাজ থেকে কিছু পণ্য নামিয়ে বন্দরে বার্থিং উপযোগী করার পর জাহাজ বন্দর অভ্যন্তরে এসে পণ্য খালাস করে। আবার কিছু পণ্য লাইটারেজের মাধ্যমে পুরো জাহাজ খালাস করা হয়।
বিশেষত, পাথর, কয়লা, সার, গম, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, ভুট্টাসহ কয়েক ধরনের পণ্য মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে খালাস হয়। এক্ষেত্রে শুল্কায়ন শেষে জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের অনুমোদন পেলে আমদানিকারক মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস ও পরিবহনের জন্য লোকাল শিপিং এজেন্ট নিয়োগ করেন। লোকাল শিপিং এজেন্ট পরবর্তীসময়ে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) বাল্ক খালাসের জন্য লাইটারেজ বরাদ্দ নেন। ডব্লিউটিসি থেকে লাইটারেজ বরাদ্দ পাওয়ার পর লোকাল শিপিং এজেন্ট মাদার ভ্যাসেল থেকে বাল্কপণ্য খালাস করে গন্তব্যে নিয়ে যায়।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় লোকাল শিপিং এজেন্ট সমতা শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং এজেন্সির পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাল্কে আসা আমদানিপণ্য শুল্কায়নের পর খালাসের জন্য আমদানিকারক লোকাল শিপিং এজেন্ট মনোনীত করেন। এরপর লোকাল শিপিং এজেন্ট ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) মাধ্যমে লাইটারেজ বুকিং নেয়। ডব্লিউটিসির বুকিং করা লাইটারেজ জাহাজ দিয়ে আমদানিকারকের চাহিদামতো মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস ও নির্ধারিত গন্তব্যে পরিবহন করা হয়।