পাল বংশের শাসনামলে আরব পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরকে ‘সমন্দর’ নামে চিনতেন। ধর্মপালের শাসনামলে চট্টগ্রাম তার অধীনে ছিল। দশম ও একাদশ শতকে দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে ও আরাকানে চন্দ্র রাজারা ছিলেন চট্টগ্রামের শাসক।
আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু লা তাইং সন্দয়া ৯৫৩ সালে বাংলা অভিযানে বের হন। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তিনি চট্টগ্রাম অতিক্রম না করে সীতাকুণ্ডে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। এর শিলালিপিতে লেখা হয়-‘চেৎ ত গৌঙ্গ’ যার অর্থ হলো: যুদ্ধ করা অনুচিৎ। আরাকানী পুঁথি থেকে জানা যায়, এরপর থেকে এই এলাকার নাম হয় ‘চেত্তগৌং’। কালক্রমে চেত্তগৌং থেকে চাটিগ্রাম, চাটগাঁ, চট্টগ্রাম, চিটাগাং নামের উৎপত্তি।
১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমূদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। ...আমি সোদকাওয়াঙ ত্যাগ করে কামরূপ পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম’।
উইকিপিডিয়া মতে, সুপ্রাচীনকাল থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পরিব্রাজক, ভৌগোলিক এবং পণ্ডিতদের লিখিত বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এখানকার শাসক গৌড়ের সুলতান ও রাজাদের মুদ্রায় চট্টগ্রামকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৪৮টি নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: সূহ্মদেশ, ক্লীং, রম্যভূমি, চাতগাঁও, চট্টল, চৈত্যগ্রাম, সপ্তগ্রাম, চট্টলা, চক্রশালা, শ্রীচট্টল, চাটিগাঁ, পুস্পপুর, চিতাগঞ্জ, চাটিগ্রাম ইত্যাদি।
১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোঘল সম্রাজ্যের অংশ হয়। আরাকানদের পরাজিত করে মোঘলরা এর নাম রাখেন ইসলামাবাদ। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর কাশিম আলী খান ইসলামাবাদকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করেন। পরে এর নাম রাখা হয় চিটাগাং।
চট্টল: চট্টগ্রামের তান্ত্রিক ও পৌরাণিক নাম ছিল চট্টল। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন তন্ত্র ও পুরাণগ্রন্থে চট্টল নামটির উল্লেখ রয়েছে। ত্রিপুরার রাজমালা গ্রন্থমতে, প্রাচীনকালে এখানে চট্টভট্ট নামক কুলীন ব্রাহ্মণ জাতির নিবাস ছিল বলে এই স্থানের নামকরণ হয়েছিল চট্টল।
চতুঃগ্রাম: ব্রিটিশ আমলের গেজেটিয়ার লেখক ও’মলির মতে, সংস্কৃত চতুঃগ্রাম শব্দ থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। চতুঃ অর্থ চার। চতুঃ শব্দের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চতুঃগ্রাম হয়। চতুঃগ্রাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়।
শাৎগঙ্গ: বার্ণোলী সাহেবের মতে, আরবি শাৎগঙ্গ শব্দ বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উদ্ভব হয়েছে। শাৎ অর্থ ব-দ্বীপ, গঙ্গ অর্থ গঙ্গা নদী। চট্টগ্রাম গঙ্গা নদীর মোহনাস্থিত ব-দ্বীপ, প্রাচীন আরব বণিক-নাবিকদের এই ধারণা থেকে এর নামকরণ করা হয়েছিল শাৎগঙ্গ। পরবর্তীকালে শাৎগঙ্গ নাম বিবর্তিত হয়ে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি।
চৈত্যগ্রাম: বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অভিমত, প্রাচীনকালে এখানে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য অবস্থিত ছিল বলে এ স্থানের নাম হয় চৈত্যগ্রাম। চৈত্য অর্থ বৌদ্ধমন্দির বা কেয়াং বা বিহার। এই চৈত্যের সঙ্গে গ্রাম শব্দ যুক্ত হয়ে চৈত্যগ্রাম নামের উদ্ভব হয়।
চাটিগ্রাম: রাজোয়াং বর্ণিত চিৎ তৌৎ গৌং নামটি মধ্যযুগে বিবর্তিত হয়ে চাটিগ্রাম রূপ প্রাপ্ত হয়। গৌড়ের রাজা গণেশ দনুজমর্দন দেবের ১৩৩৯-১৩৪০ শকাব্দে ও রাজা মহেন্দ্র দেবের ১৩৪০ শকাব্দে তৈরি মুদ্রায় টাকশালের নাম চাটিগ্রাম উল্লেখ করা হয়। বাংলার সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ ও সৈয়দ নাসির উদ্দিন নশরত শাহ্’র আমলে কবীন্দ্র পরমেশ্বর বিরচিত পরাগলী মহাভারতে এবং বৈষ্ণব সাহিত্য চৈতন্য ভাগবতে চাটিগ্রাম নামের উল্লেখ রয়েছে।
চাটিজান: প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, প্রাচীনকালে চট্টগ্রাম ছিল জ্বীন-পরী অধ্যুষিত দেশ। পীর বদর শাহ্ এখানে আগমন করে অলৌকিক চাটির (মৃৎ-প্রদীপ) আলোর তেজের সাহায্যে জ্বীন-পরী বিতাড়িত করে আজান দেওয়ার ফলে এই স্থানের নাম হয় চাটিজান।
চতকাঁও বা চাটগাঁও: বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ ও সুলতান জালালুদ্দিন মোহাম্মদ শাহ এর মুদ্রায় চতকাঁও টাকশালের নাম উল্লেখ রয়েছে। ১৩৯৭ খ্রিস্টাব্দে সুফি সাধক মুজাফফর শামস বলখির চিঠিতে চাটগাঁও নাম উল্লেখ করা হয়।
চাটিকিয়াং: চীন দেশ থেকে ১৪০৯, ১৪১২, ১৪১৫, ১৪২২ বা ১৪২৩, ১৪২৯ ও ১৪৩২ খ্রিস্টাব্দে মোট সাতবার বাংলার সুলতানদের দরবারে রাজদূত প্রেরিত হয়েছিল। তাদের লিখিত বিবরণে চট্টগ্রামকে চাটিকিয়াং নামে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
শাতজাম: তুর্কি সুলতান সোলায়মানের রেডফ্লিটের ক্যাপ্টেন সিদি আলী চেহেলভি ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে জাহাজযোগে ভারত মহাসাগরীয় দেশসমূহ পরিভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি আরাকান থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন। তার ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম শাতজাম নামে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
চার্টিগান: পরিব্রাজক রালফ ফিচ ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পরিভ্রমণ করেন। তার লিখিত ভ্রমণকাহিনীতে চট্টগ্রামের নাম চার্টিগান উল্লেখ করা হয়েছে।
জেটিগা: ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ফ্যান্ডেন ব্রুক অঙ্কিত মানচিত্রে চট্টগ্রামের নাম লেখা হয়েছে ‘জেটিগা’।
চট্টগ্রামের রয়েছে প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য, কিংবদন্তি এবং উত্তরাধিকার। চাটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গা ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য ভাষা এবং চট্টগ্রামের প্রধান ভাষা। বাংলা ভাষার সঙ্গে চাটগাঁইয়ার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও একে প্রায়ই বাংলা প্রমিত ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও ভাষাদ্বয় পারস্পরিক একই অর্থে বোধগম্য হয় না।
বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলেন। ২০২০ সালে কানাডাভিত্তিক ওয়েবসাইট ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টে প্রকাশিত বিশ্বের ১০০টি কথ্য ভাষার তালিকায় স্থান পায় চাটগাঁইয়া ভাষা। যেটি ১ কোটি ৩০ লাখ কথ্য ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে পৃথিবীর ৮৮তম বৃহত্তম ভাষা ও বাংলাদেশে কথ্য ভাষার দিক দিয়ে ১ম বৃহত্তম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। চাটগাঁইয়া বুলির নিজস্ব কোনও অক্ষর না থাকায় এ ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে বাংলা অক্ষরে লিখতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।
২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় ইংরেজি বানান ‘চিটাগং’ পরিবর্তন করে ‘চট্টগ্রাম’ করা হয়।
ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, বাংলাদেশের সকল জীবিত শহরের মধ্যে বড় চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের বয়স কম করে হলেও ১২শ বছর। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে যারা বেড়াতে এসেছিলেন, যেমন: চীন- তারা চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসতেন। এরকম বন্দর কলকাতার কাছে হুগলীর মোহনায় ছিল-সপ্তগ্রাম। আর এটা হলো চট্টগ্রাম। বাংলাদেশে প্রথম পরাগলি মহাভারতের অনুবাদ হয় চট্টগ্রাম অঞ্চলের কবিন্দ্র পরমেশ্বরের অনুবাদে। এটা ছিল বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি।