আজ রবিবার ৫ মে ২০২৪, ২২শে বৈশাখ ১৪৩১

নিয়মের তোয়াক্কাই করেনি প্ল্যান্ট মালিক

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৬ মার্চ ২০২৩ ০৬:৪৪:০০ অপরাহ্ন | উত্তর চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম: টাকা বাঁচাতে গিয়ে অদক্ষ জনবল দিয়েই অক্সিজেন প্ল্যান্টের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন কারখানার মালিক। মাত্র দুইজন ডিপ্লোমাধারী অপারেটর দিয়ে চলতো সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট।

 

দক্ষ কর্মীদের ছাঁটাই করে ওই দুই ডিপ্লোমাধারী হাতেই দেওয়া হয় পুরো কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির ৮টি ক্যাটাগরির মধ্যে ৬ সংস্থার কোনো অনুমোদন ছিল না।

 

 

গত শনিবার (৪ মার্চ) সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকার সীমা অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণে ৭ জন নিহত হয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেন অনেকেই। শরীরে বিভিন্ন জায়গায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৫ জনের অধিক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে চীন থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করে প্লান্টটি উৎপাদনের কাজ শুরু করে। দুই মাস চীনা শ্রমিকরা সার্ভিস দিলেও গত ২০ বছর তাদের কোনো খবর নেই। প্রথম দিকে ৫০ হাজার টাকা বেতনে দক্ষ শ্রমিক নিয়ে কাজ চালালেও পরে টাকা কমাতে ২০ হাজার টাকা বেতনে মাত্র কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় শ্রমিকদের নিয়োগ দেয় সীমা অক্সিজেন প্ল্যাট কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি শিফটে ১৪ জন করে কাজ করেন। এরমধ্যে দুই জন অপারেটর রয়েছেন, তাদের হাতেই মূল পরিচালনার দায়িত্ব ছিল। বাকিরা ছিল বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন শিল্পকারখানায় অক্সিজেন সরবরাহ করতো।  

জানা গেছে, অক্সিজেন প্লান্টটি ছিল চীন থেকে আমদানি করা। ১৯৯৬ সালে প্লান্টটি স্থাপন করার পর থেকে মাত্র দুবার তাঁরা পরিদর্শনে এসেছেন। যখন প্লান্টটি স্থাপন করা হয় তখন কর্মচারীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শুরুতে যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তারা অনেকেই এখন সেখানে কাজ করেন না। কারণ অভিজ্ঞ এদের বেতন দিতে হতো ৫০-৬০ হাজার টাকা করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রাপ্য বেতন না দেওয়ায় তারা অনেকটা বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। পরে অদক্ষ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনভিজ্ঞ জনবল দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছিলেন।  

প্রতিষ্ঠানটির যিনি পরিচালনা করছেন তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন। তিনি নিজেও টেকনিক্যাল বিষয়ে  পড়াশোনা করেননি। পড়েছেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগ থেকে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে সাধারণত মেকানিক্যাল বা বিজ্ঞান বিভাগের জনবল দিয়ে পরিচালনা হওয়ার কথা। কিন্তু উৎপাদনের দায়িত্বে থাকা ৩ জনের কারও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা বা অভিজ্ঞতা ছিল না।  

তবে কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ডিপ্লোমাধারী।  

ফায়ার সার্ভিস, কলকারখানার পরিদর্শক অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে অপরিকল্পিতভাবে জিনিসপত্র রাখা হয়েছে। ফায়ার সেফটি ছিল না। দুর্ঘটনা ঘটলে, সবার যে অ্যাসেম্বলি পয়েন্ট, সেগুলোও ছিল না। নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইডের মজুতের নেই কোনো অনুমোদন। ছিল না পরিবেশের ছাড়পত্র, বিদ্যুত বিভাগ, বয়লার পরিদর্শক দপ্তর ও জেলা প্রশাসন অফিসের অনুমতিও।  

সোমবার (৬ মার্চ) দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শিল্পকারখানার মালিকদের সঙ্গে বসেন। সেখানে অবশ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুন উদ্দিন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। দুর্ঘটনার কারণ আল্লাহ-ই ভালো জানেন বলে মন্তব্য করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা তিনজনের মধ্যে একজন মানবিক বিভাগের বাকি দুজন ডিপ্লোমাধারী। এমনকি নিজেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেননি।  

সভায় চট্টগ্রামের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তরের প্রধান আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত বলেন, সীতাকুণ্ডে ৫৫০টি কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট একটি। প্রতিষ্ঠানটিতে পরিদর্শন করে বেশকিছু সমস্যা পেয়েছিলাম। পরে মৌখিকভাবে তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এমনকি চিঠিও দেওয়া হয়। তারা তখন ৩ মাসের সময় চেয়ে, বেশকিছু সমস্যার মধ্যে কিছু সমস্যা তারা সলভও করে। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে আরেকটি ইরেসপেকশন হওয়ার কথা ছিল। এরমধ্যে বিস্ফোরণ হয়। একই মালিকের আরেকটি প্রতিষ্ঠান অটো রিয়েওলিং মিলও অনেকগুলো সমস্যা পাওয়ার পর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তর বাদি হয়ে চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করেন বলে জানান তিনি।  

চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আব্দুল মালেক বলেন, ৯ মাস আগে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিস সতর্ক হয়ে যায়। সেটির ধারবাহিকতায় বিভিন্ন কারখানায় পরির্শন করা হয়। ২০২২ সালে সীমা অক্সিজেন প্লান্টেও বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। ফায়ার সেফটি প্লান ছিল না সীমা অক্সিজেন প্লান্টে।  

বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের সহকারী পরিদর্শক এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সীমা অক্সিজেন প্লান্টে পরিদর্শন করে আমরা নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইডের ব্যবহার পেয়েছি। অথচ এসব মজুতের কোনো অনুমোদন ছিল না। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে অদক্ষ কর্মচারী যারা প্লান্টটি পরিচালনা করা হতো। সর্বশেষ কবে তারা সেফটি ভাল্ব, পরিচালনার কাজের জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্রের ব্যবহারের কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেননি।