আজ সোমবার ২০ মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নতুন অর্থবছরে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ৮ চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক : | প্রকাশের সময় : সোমবার ৬ জুন ২০২২ ০৬:৪৯:০০ অপরাহ্ন | অর্থনীতি ও বাণিজ্য

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতির গতি বাড়াতে আগামী (২০২২-২৩) অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেটে অন্যান্য বারের মতো স্বাস্থ্য ও কর্মসৃজনে প্রাধান্য থাকবে। এবার আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করছে সরকার।

জানা গেছে, প্রতি বছরের মতো এবারও বাজেট প্রণয়নের অংশ হিসেবে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন, স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কিছু ক্ষেত্রে আওতা বেড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দও বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তায় কিছু পলিসি সাপোর্ট আবার কিছু ক্যাশ সাপোর্টও থাকে। আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এবার কিছু বাড়তি সতর্কতা থাকবে। স্বাস্থ্য, কর্মসৃজনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব থাকবে। বিগত কয়েক বছরের মতো স্বাস্থ্যখাত গুরুত্ব দেওয়া হবে। মানুষের কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে এটি বিস্তৃত করা হবে। 

এছাড়া মন্ত্রণালয়/বিভাগ এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে বাজেটের ওপর প্রস্তাবনা এসেছে। সবার সঙ্গে আলোচনা, তাদের প্রস্তাবনা ও মন্ত্রণালয়ের সার্বিক বিশ্লেষণে আগামী অর্থবছরের জন্য আটটি প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কর্মসৃজন, আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংকঋণের সুদহার বর্তমান পর্যায়ে রাখা, রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর বিষয়গুলো প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এসব বিষয় মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে আগামী অর্থবছরের বাজেট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের বাজেট প্রণয়ন সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনীতি গতিশীল করতে এবার ব্যতিক্রমী বাজেট ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া করোনার কারণে পিছিয়ে পড়া মানুষদের নতুন করে বাড়তি সুরক্ষা দিতে বাজেটে থাকতে হবে বিশেষ উদ্যোগ। নজর রাখতে হবে মূল্যস্ফীতির দিকে।

আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান, বেসরকারি বিনিয়োগ অব্যাহত রেখে কর্মসৃজন, আমদানি সহনীয় পর্যায়ে রেখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল রাখা, ব্যাংকঋণের সুদহার বর্তমান পর্যায়ে রাখা, রাজস্বের পরিমাণ বাড়ানো ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোর বিষয়গুলোকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের কিছু ক্ষেত্রে আওতা বেড়েছে, কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দও বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তায় কিছু পলিসি সাপোর্ট আবার কিছু ক্যাশ সাপোর্টও থাকে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও এবার কিছু বাড়তি সতর্কতা থাকবে। স্বাস্থ্য, কর্মসৃজনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব থাকবে। বিগত কয়েক বছরের মতো স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। মানুষের কর্মক্ষেত্র নিশ্চিত করাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে ধরা হয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে এটিকে বিস্তৃত করা হবে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ঘোষিত বাজেটের আকার ছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। এবার ৭৪ হাজার ১৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হবে। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে যা ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ ও সরকারি খাত থেকে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বিনিয়োগ আসবে।

বাজেটে টাকার অঙ্কে নতুন জিডিপির আকার হচ্ছে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া আছে। আগামী অর্থবছরে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে, যা জিডিপির ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।

আগামী বাজেটে মোট আয়ের মধ্যে নন-এনবিআর থেকে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। এবারের বাজেটে করবহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, আসন্ন বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ঘাটতি ধরা হবে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাত প্রশস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা প্রশস্ত করা হয়েছে। যে চ্যালেঞ্জিং সময় মোকাবিলা করে যাচ্ছি এসময়ে আমাদের দেশের মানুষকে যতোটা পারি সহায়তা করব। ন্যায়সঙ্গত হবে না এমন কিছু তাদের ওপর চাপিয়ে দেবো না। বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে অনিশ্চয়তা। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা বিরাজমান এর মাঝে কেমন করে আমাদের অর্থনীতিতে আমরা জায়গা করে নিতে পারি, আমরা কীভাবে গতিশীল করতে পারি সেগুলো বাজেটে জায়গা পেয়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বাজেট বাস্তবায়নের আগে বাজেটের হিসাব যেভাবে করা হয় সেই জায়গায়ই আমার মনে হয় আরও কাজ করার আছে। ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয় এটি না করে বরং আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে যদি ব্যয়ের কাঠামো ঠিক করা যেতো অথবা অর্থ সরবরাহের উৎসগুলো নিশ্চিত করে যদি ব্যয় কাঠামো ঠিক করা যেতো সেটা অনেকটা বাজেট বাস্তবায়নের কাছাকাছি যেতো। কিন্তু দেখা যায় ব্যয়ের বিষয়টি আমাদের এখানে প্রাধিকার দেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে বাজেট বড় আকার ধারণ করে। ’

তিনি বলেন, আমাদের মতো উদীয়মান দেশে বর্ধিত বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি বর্ধিত বাজেট কাঠামোতে যতোটা বাস্তবায়ন হয় ততো অপচয় এড়ানো যায়। বিভিন্ন রকমের দুর্নীতি এড়ানোর সুযোগ থাকে। বিভিন্ন ধরনের অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এড়ানোর সুযোগ থাকে। সেই জায়গায় আমরা মনে করি পর্যাপ্তভাবে বাজেট প্রস্তুতকালে যে ধরনের সৃজনশীলতা দেখানো সেই জায়গাটি আমাদের হয়ে ওঠেনি। এখনও অনেকটা রাজনৈতিক প্রভাবে বিভিন্ন রকমের টার্গেট মাথায় রেখে হচ্ছে, সেগুলো আয়ের সঙ্গে সম্পর্কের বাইরে থাকে। যেটা পরে সরকারকে বড় বাজেট কাটছাঁট করতে বাধ্য করে।

তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে মূল্যায়নের অভাব থাকে, সেজন্য ব্যয় বেড়ে যায়। এবং এসব জায়গায় যদি কম্পেটিভ বিডিংগুলো নিশ্চিত করা যায় তাহলেও অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ থাকে। সে জায়গায় আমাদের আরও উন্নতির দরকার আছে। বাজেট বাস্তবায়নকালে এই প্রক্রিয়াগুলোতে আরও বেশি স্বচ্ছভাবে ইমপ্লিমেন্টেশনের জায়গাগুলো দেখা। বিশেষ করে ইমপ্লিমেন্টের জায়গাগুলোতে সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিও রাখা। যাতে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নকালে তারাও এর ওনারশিপ নিতে পারে। তাদের যদি মতামত থাকে মতামত দিতে পারে। যেকোনো অনিয়ম হলে তারা যাতে সামনাসামনি দেখতে পারে। এক ধরনের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার কাঠামোও তৈরি হয় এর মাধ্যমে, এটি দরকার। আরেকটি হলো প্রকল্পকালে এর অডিট কার্যক্রমগুলো যদি আরও স্বচ্ছভাবে করা যায় তাহলে অর্থ সাশ্রয় যেভাবে করা যাবে তেমনি প্রকল্প সময়কাল ধরে শেষ করারও তাগিদ তৈরি হবে।’