চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) প্রধান ছাত্রাবাসে ‘শিবির সন্দেহে’ চার শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।
আহতরা হলেন, এম এ রাইয়ান, মোবাশ্বির হোসাইন শুভ্র, জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেন। তারা সবাই চমেকের ৬২তম ব্যাচের ছাত্র এবং প্রধান ছাত্রাবাসে থাকেন। আহতদের মধ্যে জাহিদ হোসাইন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেনকে চমেক হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউতে) ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া আহত এমএ রাইয়ান কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং শুভ্র নারায়ণগঞ্জে একজন অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দাবি, দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর ওই চার শিক্ষার্থী শিবির করেন বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তাদের কক্ষ থেকে জিহাদি বই এবং দেশীয় অস্ত্র পাওয়া গেছে। এছাড়াও তাদের মোবাইলে শিবির করার প্রমাণ পেয়েছেন বলে দাবি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের।
এ ঘটনায় শিগগিরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছে কলেজ প্রশাসন। যদিও শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৩টা পর্যন্ত নগরের চকবাজার থানায় ভুক্তভোগী কিংবা তাদের পরিবারের কেউ অভিযোগ দায়ের করেননি।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী এবং চমেকের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন চমেকের ৬০তম ব্যাচের ছাত্র অভিজিৎ দাশ ও শামীম, ৫৯তম ব্যাচের ছাত্র রিয়াজুল ইসলাম জয়, ৬১তম ব্যাচের ইমতিয়াজ হাবীব, ৬২তম ব্যাচের মাহিন আহমেদ, ইব্রাহিম সাকিব, চমন অনয়, সৌরভ দেবনাথ ও জাকির হোসাইন সায়ালসহ ১০ থেকে ১৫ জন। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং চমেক ক্যাম্পাসে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ছাত্রলীগের অন্য পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের কয়েকজন চমেক থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার হয়েছেন।
জানা গেছে, বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) গভীর রাতে চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষ থেকে শিবির সন্দেহে চার শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যায় অভিযুক্তরা। পরে তাদের ছাত্রাবাসের তৃতীয় তলার একটি 'টর্চার সেলে' রাখা হয়। সেখানে অভিযুক্তরা লাঠি এবং প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে ভুক্তভোগীদের বেধড়ক মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে রাইয়ান গুরুতর আহত হয়। বৃহস্পতিবার ভোর ৬টার দিকে তাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আবার ছাত্রাবাসে নিয়ে আসা হয়।
নির্যাতনের শিকার এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বুধবার রাতে অভিযুক্তরা আমাদের হোস্টেলের তৃতীয় তলার একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেধড়ক মারধর করে। লাঠি এবং প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে মেরে মেরে তারা বলেন, যতক্ষণ স্বীকার করবে না ততক্ষণ এভাবে মারধর করা হবে। নির্যাতন সইতে না পেরে জান বাঁচাতে একপর্যায়ে আমরা স্বীকারোক্তি দিয়েছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত অভিজিৎ দাশ বলেন, চমেক ছাত্রাবাসে আমরা নিষিদ্ধ জামায়াত শিবিরের কর্মকাণ্ড দেখতে পেয়ে এক সপ্তাহ ধরে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নজরদারিতে রাখি। গত বুধবার আমরা নিশ্চিত হওয়ার পর চারজনের রুমে আমরা ছেলেদের পাঠাই। ওখানে গিয়ে আমরা দেশীয় অস্ত্র ও জিহাদি বই পাই। তবে তারা ওইসময় রুমে ছিল না। বুধবার রাতে আমরা তাদের রুমে ডাকি। এ সময় তারা মোবাইল ছাড়া খালি হাতে রুমে আসে। এরপর আমরা তাদের নিয়ে পুনরায় রুমে গিয়ে মোবাইল উদ্ধার করি। মোবাইলে তাদের সঙ্গে মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শিবিরের নেতাদের সঙ্গে সংযোগ পাওয়া যায় এবং চা-চক্র ও সাথী সমাবেশ করার পরিকল্পনা পাওয়া যায়।
তিনি আরও বলেন, তাদের মোবাইলে আমরা ১৮ থেকে ২০ জনের লিস্ট পেয়েছি। যাদের তারা সংঘটিত করেছে। আসলেই তারা শিবির করে। তারা নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছিল। বিষয়টি আমরা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়েছি। তাদের কয়েকজনের মোবাইল আমাদের হাতে আছে।
মারধর করা কেন করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে, জোরজবরদস্তি করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে। মারধর করা হয়নি। মেডিকেলের স্টুডেন্ট হিসেবে নরমাল ইনজুরি দেখিয়ে যে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। এটি জটিল কোনো বিষয় নয়।
চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার বলেন, আমরা এখনো কোনো কিছু জানতে পারেনি। ভুক্তভোগীদের অনেকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি কিন্তু তারা মুখ খুলছে না। আমরা দুজনকে উদ্ধার করেছি। বাকি দুজন বাড়িতে গেছে। কেউ না কেউ তাদের মারছে। সবগুলো বিষয় বিবেচনা করে আমরা তদন্ত করছি। অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে চমেক অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু আইসিইউতে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার থাকেন সেজন্য দুজনকে সেখানে রাখা হয়েছে। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আমরা মেডিকেল বোর্ড করেছি। তারা মোটামুটি সুস্থ আছে। নির্যাতনের খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার তাদের আমরা পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করেছি। তখন তারা কারও নাম বলেননি। তারা বাথরুম থেকে পড়ে আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে। আপাতত তারা সুস্থ হোক। আগামীকাল (শনিবার) অফিস খুললে আমরা তদন্ত কমিটি করে কারণ খুঁজে বের করব।
চারজন একসঙ্গে বাথরুমে পড়ে আহত হওয়া সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তারা তো কেউ মুখ খুলছে না। আপাতত তারা সুস্থ হোক। আমরা তো কাউকে ছেড়ে দিচ্ছি না।