চট্টগ্রামের জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে অস্থিরতা তৈরির পেছনে ৭৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে স্থানীয় দখলদার ছাড়াও বাইরের কয়েকজন প্রভাবশালীর নামও উঠে এসেছে। তারা সলিমপুরে অবৈধ দখলদারদের ধরে রাখার পাশাপাশি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া সলিমপুরে সরকারের উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা ভেস্তে দিতেও তারা চেষ্টা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এমন ষড়যন্ত্রে জড়িতদের তালিকা তৈরি করে নজরদারির পাশাপাশি তাদের গ্রেফতারে অভিযান পরিচালনা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল আলম বলেন, জঙ্গল সলিমপুরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টায় ৭৭ জনের একটি চক্র কাজ করছে। এই চক্রের বেশিরভাগই সলিমপুরে অবৈধ দখলে নেতৃত্বে থাকা সন্ত্রাসী ইয়াসিন বাহিনীর অনুসারী।
তিনি জানান, প্রশাসন ও পুলিশকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করে আসছিল পক্ষটি। তারা হোয়াটসঅ্যাপে একটি বিশেষ গ্রুপের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করেছে। আকতার হোসেন নামে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের এক সদস্যের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সেটি বিশ্লেষণ করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আলিনগরের সন্ত্রাসীদের সরকার ও প্রশাসনবিরোধী কর্মকাণ্ডের এ সত্যতা পাওয়া যায়। পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৯ জনকে রবিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়। কোতোয়ালি থানা পুলিশের মাধ্যমে গ্রেফতারের পর তাদের সীতাকুণ্ড থানায় সোপর্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। ওইসব মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয় সূত্র জানায়, জঙ্গল সলিমপুরে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ৩১ আগস্টের মধ্যে সরে যেতে মাইকিং করা হয়। উল্লেখিত সময়ের মধ্যে অনেক পরিবার সরে যেতেও চেয়েছিল। তবে তাদের আটকে দিয়ে আন্দোলনের চেষ্টা চালায় ৭৭ জনের চক্রটি। পরে আটকে দেওয়া লোকজনকে উদ্ধারে বৃহস্পতিবার অভিযান চালানো হলে দখলদাররা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করে ইট-পাথরও নিক্ষেপ করে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন।
সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক বলেন, ‘প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে বসবাসকারী অনেক পরিবার জঙ্গল সলিমপুর ও আলী নগর ছেড়ে চলে যেতে প্রস্তুতি নিয়েছিল। এমনকি অনেকে মালামাল নিয়ে চলেও যাচ্ছিল। তবে তাদের আটকে দিয়েছিল সেখানকার সন্ত্রাসীরা। এমন খবর পেয়ে আটকেপড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারে বৃহস্পতিবার অভিযান চালানো হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে গেলে দখলদার সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে বেশ ক’জন পুলিশ ও আনসার সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানার এসআই শামীউর রহমান বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে দুটি মামলা দায়ের করেন। দুটি মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৩০/১৪০ জনকে আসামি করা হয়।’
এদিকে চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরাম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগর এলাকায় সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় ছিল তিন হাজার ১০০ একর। কিন্তু দুই যুগের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জনের চিহ্নিত ভূমিদস্যু চট্টগ্রামের এই জঙ্গল সলিমপুর এবং আলিনগর এলাকায় পাহাড় কেটে আলাদা এক সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। গড়ে তুলেছে দেশের ভেতর আরেক দেশ। তাদের সহযোগী হিসেবে আছেন আরও তিনশ’ জন দখলদার। এই ভূমিদস্যুরা ২০০০ সাল থেকে যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল, তখন সে দলের ব্যানার টাঙিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য সুদৃঢ় করেছে। তারা প্রতিনিয়ত সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত পাহাড় কেটে প্লট বানিয়ে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের কাছে ভাড়া কিংবা দখল বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একইসঙ্গে পাহাড়ের ভেতর ভূমিদস্যুরা গড়ে তুলেছিল অস্ত্র, সন্ত্রাস, মাদক ও চোরাচালানের ভয়ঙ্কর একাধিক আস্তানা। এদের মধ্যে আবার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে প্রতিনিয়ত চলতো সংঘর্ষ, বন্ধুকযুদ্ধ, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা। এসব ভূমিদস্যুরা ৪০ শতাংশ পাহাড় কেটে ফেলেছে বলেও অভিযোগ করে চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরাম।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, জঙ্গল সলিমপুরে পাহাড় কাটা ও পাহাড় দখলের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে রয়েছে- ইয়াছিন বাহিনী, আল আমিন বাহিনী, মকবুল শেখ বাহিনী, আক্কাছ বাহিনী, আবছার বাহিনী, জামাল বাহিনী, গাজী সাদেকুর রহমান বাহিনী, মশিউর রহমান বাহিনী, গোলাম গফুর বাহিনীসহ আরও অনেকেই। এসব পাহাড় খেকোরা কাজের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম মহানগর ছিন্নমূল বস্তিবাসী সমন্বয় সংগ্রাম পরিষদসহ কয়েকটি সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেছে। জঙ্গল সলিমপুরে আট হাজার পরিবারে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। তবে সম্প্রতি আদম শুমারিতে ১৯ হাজার মানুষের তথ্য মিলেছে। ওই এলাকায় থাকতে হলে সমিতির সদস্য হতে হতো। মেনে চলতে হতো সমিতির নিয়ম-কানুন। কাজের সুবিধার্থে তাই পুরো এলাকাকে ১১টি ‘সমাজে’ ভাগ করা হয়। কোথায় কোন পাহাড় কাটা হবে, কোথায় কোন সড়ক তৈরি হবে, কখন কে সরকারি সাহায্য পাবে, তা নির্ধারণ করতো ১১টি সমাজের ১১ শীর্ষ ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, মশিউর ও সাদেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করছিল ওই ১১ জন।
একইভাবে আলিনগরেও ছিল সন্ত্রাসীদের ব্যাপক আধিক্য। অভিযোগ রয়েছে এখানে মো. হেকিম, মো. ইয়াছিন ও মো. ফারুকের রাজত্ব চলছিল। কাজের সুবিধার্থে তারা আলিনগর সমবায় সমিতি গঠন করে। এ এলাকায় পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম রয়েছে তালিকায়। তাদের মধ্যে রয়েছে- আকতার, আইনুল, ইয়াকুব, আনোয়ার হোসেন নয়ন, খোকরা শাহজাহান, নুরুল হক ভান্ডারি, ধামা জাহাঙ্গীর অন্যতম।
অভিযোগ রয়েছে, এই এলাকার পাহাড় কাটতে নিতে হয় সমিতি থেকে টোকেন। জঙ্গল সলিমপুর ও আলিনগরে সমিতির পক্ষে দৈনিক ৫০০ টাকার টোকেন দিয়ে পাহাড় কাটা হয়। বসতি স্থাপনে ইচ্ছুক ব্যক্তি এ টোকেনের বিনিময়ে একদিনের জন্য পাহাড় কাটার অনুমতি পান। এভাবে যতদিন পাহাড়টি বসবাসের উপযোগী না হবে, ততদিন দৈনিক ভিত্তিতে টোকেন নবায়ন করতে হয়। বসবাসের উপযোগী হলে জায়গাটি বায়নামূলে বিক্রি করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের কয়েকজন জানান, সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য খ্যাত এই জঙ্গল সলিমপুরে ৯০ দশকে দুর্র্ধষ সন্ত্রাসী ভূমিদস্যু আলী আক্কাস এসে প্রথম আস্তানা গড়ে তোলে। চট্টগ্রামের খুব কাছের এলাকা হওয়ায় বিভিন্ন নিম্নআয়ের মানুষকে টোপ দিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়। পাহাড় কেটে তাদের কাছে প্লট বিক্রি শুরু হয়। এভাবে আক্কাসের অর্থসম্পদ বাড়ার পাশাপাশি বাহিনীর আকার বাড়ে। বেপরোয়া কার্যকলাপের কারণে ২০১০ সালে র্যাবের সঙ্গে ক্রস ফায়ারে আক্কাস নিহত হন। এরপর তার অনুসারী রোকন উদ্দিনের হাতে আসে নেতৃত্ব। কিন্তু সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর নেতৃত্ব দখলে নেন মশিউর, ইয়াসিন, ইয়াসিনের ভাই ফারুক, গাজী সাদেক, গফুর মেম্বার, রিপন, আরিফ, আল আমিন সাগরসহ অনেকেই। ইয়াসিনের বিরুদ্ধে নোয়াখালীর সেনবাগ ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় এক ডজনের অধিক প্রতারণা, খুন, অস্ত্র, বিস্ফোরক আইন এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, জঙ্গল সলিমপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক সোমবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটায় অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস। সভায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধান উপস্থিত ছিলেন। সভায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, সিডিএ চেয়ারম্যানও অংশ নেন। সভায় পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরমধ্যে জঙ্গল সলিমপুরে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য গড়ে তোলা তিন হাজার ১০০ একর জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা এবং জমি উদ্ধারের পর সেখানে জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রতিবেশ অক্ষুণ্ণ রেখে সরকারের পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে কয়েকটি টাস্কফোর্স কমিটি গঠিত হয়।
সভায় জঙ্গল সলিমপুরে যারা প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীন রয়েছেন তাদের স্থায়ী ঠিকানায় স্ব স্ব উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্প ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের মাধ্যমে আবাসনের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া জঙ্গল সলিমপুরে সন্ত্রাস, ভূমিদস্যুতা ও মাদকের রাজত্ব কায়েম করা সন্ত্রাসী-আসামিদের গ্রেফতারে অবিলম্বে অভিযান পরিচালনা করা হবে। সভায় আগামী এক মাসের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যান করে তা বাস্তবায়ন করার জন্যে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন হলে জঙ্গল সলিমপুর এলাকার অন্ধকার যুগের অবসান ঘটবে। বেহাত হওয়া খাস জমি ভূমিদস্যুরা সাধারণ মানুষের কাছে প্লট অনুযায়ী দখলস্বত্ব বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে এবং কয়েকজন কারাগারেও আছেন বলে জানান তিনি।