কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলায় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে ব্যাংকের চেক ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে চুক্তিবদ্ধ হয়ে একের পর এক হচ্ছে বাল্যবিবাহ। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের নীরব ভূমিকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে করেন সচেতন মহল।
বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে ঈদগাঁও উপজেলায় বাল্যবিবাহের হার ছিল ৮২ শতাংশ। সম্প্রতি এ হার আরও বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে যায়, উপজেলার ইসলামপুর, পোকখালী, ইসলামাবাদ, জালালাবাদ, ঈদগাঁও ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে বাল্যবিবাহের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। ঈদগাঁও উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের নিকাহ নিবন্ধনকারীদের (কাজি) শক্ত ভূমিকার কারণে বিয়ে সম্পাদনা করতে না পেরে অনেকেই বেছে নিয়েছে নোটারি পাবলিক, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ও ব্যাংকের চেকের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ। উল্লিখিত পন্থাগুলো পূর্ণ বয়স হলে কাবিননামা সম্পাদন করার একটি অঙ্গীকারনামা বলে জানান কাজিরা।
সচেতন মহলের দাবি, প্রবাসী-অর্থবিত্তের মালিক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ছেলে পছন্দ হলেই অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের অভিভাবক ও স্বজনরা বয়স ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বিবেচনা না করে কথাবার্তা চূড়ান্ত করে ফেলে। আবার স্কুল, মাদরাসার সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণিপড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে লাপাত্তা হচ্ছে। এরপর অভিভাবকরা তাদের খুঁজে বের করে দুপক্ষ মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটেন। এতে সহযোগিতা করে এলাকার কিছু সমাজপতি, জনপ্রতিনিধি ও মাতবর গোছের লোক।
প্রাপ্ত বয়স না হলে সরকারি তালিকাভুক্ত কাজিরা এ বিয়ে বালাম বইতে অন্তর্ভুক্ত না করতে চাইলে তাদের গুটি কয়েক সহকারী, কাজি অফিসের দালাল চক্র ভিন্ন পন্থায় নকল বালাম বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে বলে অভিযোগ আছে। তাতেও যদি ব্যর্থ হয় পরে তারা ব্যাংকের চেক ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পূরণ করে অঙ্গীকারবদ্ধ হন যে মেয়ের বয়স ১৮, ছেলের বয়স ২১ হলে নিকাহনামা (কাবিন) করাবেন।
স্থানীয়দের দাবি, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সমাজপতিদের সহযোগিতায় এলাকার অভিভাবক মহল তাদের মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেন। সচেতনতা ও জবাবদিহি না থাকায় ক্রমেই বেড়েই চলেছে এ বাল্যবিবাহের ঘটনা।
রাবিয়া আক্তার নামের একজন নারীনেত্রী জানান, বাল্যবিবাহ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ঈদগাঁও উপজেলায়। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে ধারণা না থাকা, অসচেতনতার কারণে বাল্যবিবাহগুলো হচ্ছে। বাল্যবিবাহ বন্ধে তিনি প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, সমাজপতি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ইমাম, তথ্য উদ্যোক্তা, কাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে বাল্যবিবাহ বন্ধে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান তিনি।
করোনাকালীন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিবাহের জাতীয় গড় ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ হলেও ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে কক্সবাজার জেলায় বাল্যবিবাহের হার কয়েকটি জেলার চেয়ে বেশি।
কক্সবাজার জেলার ৯ উপজেলা ৭১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩২টি ইউনিয়ন এবং ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৩টি পৌরসভার ওপর জরিপ করে দেখা যায়, ঈদগাঁও উপজেলায় বাল্যবিবাহের হার সর্বোচ্চ ৮২ শতাংশ। এরপর রয়েছে উখিয়া উপজেলায় ৭৫ শতাংশ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি সারসংক্ষেপে বলেন, ঈদগাঁও-উখিয়ার পর তুলনামূলক বাল্যবিবাহের হার বেশি রামু উপজেলায়, ৭২ শতাংশ। টেকনাফে ৬৬, মহেশখালীতে ৬১, কুতুবদিয়ায় ৫৪ ও সদরে ৫১ শতাংশ। সবচেয়ে বাল্যবিবাহের হার কম চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায়। চকরিয়ায় ৩২ ও পেকুয়ার ২৬ শতাংশ।
বাল্যবিবাহের বহুমাত্রিক প্রভাব নিয়ে অন্য এক উপস্থাপনায় সংস্থাটির যুগ্ম পরিচালক মো. মুজিবুল হক মুনির বলেন, বাল্যবিবাহের ফলে দেশে নারীর আয় ৯ শতাংশ এবং জাতীয় আয় ১ শতাংশ কমে যায়। বাল্যবিবাহ নিরসন করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা বাজেটে ১১ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার অফিস সেটআপ না হওয়ায় কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বাল্যবিবাহের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তা ছাড়া কাজি ও জনপ্রতিনিধিদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে যাতে কোনো শিশু বাল্যবিবাহের শিকার না হয়।
তিনি বাল্যবিবাহ বন্ধে গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষাবিদ, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সচেতন এলাকাবাসীকে এগিয়ে আশার অনুরোধ জানান।